|
|
|
|
দেবীপক্ষে স্বাগত |
মহালয়া। শিউলি ফুল। কাশের দোল। ঢাকের বোল।
সবই তো তোমাদের জন্য। কেন বুঝতে পারো না তোমরা? লিখছেন সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
যদি আসল বলতে কিছু থেকে থাকে তা হল ফেসবুক! যেখানে ‘আমি ফুচকা খাচ্ছি’ এ রকম একটা ছবি আপলোড করলে ২১৪টা ‘কমেন্ট’ পাওয়া যায়। আর কমেন্টও যেমন ‘ইস্, জিভ দিয়ে জল পড়ছে’, ‘ক’টা খেলি রে?’ ‘সাঁটিয়ে যাও বস্’।
যদি আসল বলতে কিছু থেকে থাকে তা হল রক মিউজিক। ‘নির্ভানা’, ‘লিঙ্কিন পার্ক’, ‘ডেথ মেটাল’... এ সবও পার করে এখন ‘ব্ল্যাক সাবাথ’, ‘জুডাস ক্রাইস্ট’ ব্যান্ডরা। কিছু না হোক নিজেদেরই তো আস্ত একটা ব্যান্ড আছে।
যদি আসল বলতে কিছু থেকে থাকে তা হল ল্যাপটপ, মোবাইল, অ্যান্ড্রয়েড এস ফোর। পাঞ্জার ভিতর বিগলিত একটা পৃথিবী।
আসল বলতে যা কিছু তা অবশ্যই ভারত নামক দেশের সীমানায় দাঁড়িয়ে বাইরে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। একবার এই দারিদ্র পরিপূর্ণ, পঙ্কিল রাজনীতি, ধর্ষকের দেশ থেকে বেরিয়ে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, সিঙ্গাপুর... নিদেনপক্ষে নাইজিরিয়াতেও পৌছতে পারলে তবেই জন্ম সার্থক। তবেই কিছু করে দেখানো গেল।
এ এক অর্বাচীন প্রজন্ম। যারা নিজেদের ইতিহাস জানে না। ঐতিহ্য জানে না। সংস্কার, সংস্কৃতি জানে না। যাদের সঙ্গে এ সব নিয়ে কথা বলতে গেলেও নিদারুণ আঘাত পেতে হয়। কারণ তারা মনে করে এ সবই ভুয়ো। ঐতিহ্য জানে না, পালা-পার্বণ বোঝে না। সংস্কারকে দুয়ো দেয়। কিন্তু তারা দোল খেলে। কারণ? খেলতে ভাল লাগে, তাই। কাউকে ধরে বেঁধে রং মাখাতে মজা লাগে, তাই। এ প্রজন্ম কিন্তু দুর্গাপূজো বোঝে। কারণ ওই একটাই পাঁচ-ছ’টা দিন ফাটিয়ে মজা করা যায়, লক্ষ্য-লক্ষ্যের ফ্যাশন প্যারেডে অংশ নেওয়া যায়, খাওয়া-দাওয়া, ফুর্তি-ফার্তায় ভরিয়ে রাখা যায় নিজেদের। এ সব বাদ দিলে, মা দুর্গা আর তাঁর সন্তানদের কার কী বাহন? সেটাও ঠিক মতো বলতে পারবে কি না সন্দেহ আছে।
জানি আপনাদের কেউ বিশ্বাস করতে পারবেন না, যদি আমি বলি, উনিশ বছরের একটি মেয়েকে পোস্ট-কলোনিয়াল সাহিত্য মানে কী, এটা বলতে গিয়ে শুনেছিলাম ‘দমদমের দিকেও অনেক কলোনি আছে’। সে বাংলা সাহিত্য পড়ে নামকরা এক ইউনিভার্সিটিতে। বিশ্বাস করা কঠিন যে, ‘হামান দিস্তে’ বলতে কী বোঝায়, এটা জানেই না ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া এক বাঙালি সন্তান!
অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে। কিন্তু এটাই আজ সত্যি।
ফলে দুর্গাপুজো আছে। রমরমিয়ে চলছে বলাই ভাল।
পাড়ায় পাড়ায় দুর্গাপুজো, কমপ্লেক্সে কমপ্লেক্সে দূর্গাপুজো। আছে থিম, আছে বিজ্ঞাপন। প্রাইজ আছে, রাতভর আড্ডা, পার্টি, মদ্যপান আছে। চ্যানেলে চ্যানেলে কী পরবেন, কোথায় খাবেন, কোথায় ঘুরবেন আছে। কিন্তু প্যান্ডেলের বাইরে কবে যেন মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির স্টলটা হাওয়া হয়ে গেছে।
ওই স্টলের বাংলা চটি বইগুলো এখন আর ছাপা হয় বলেও মনে হয় না।
এই উৎসবের পালে হাওয়া লাগে বহু দিন আগে। তাই আছে কাউন্টডাউন ‘আর ৪৫ দিন পর’, ‘আর ৩০ দিন পর’, ‘আর ১৫ দিন পর’, ‘আর ৭ দিন পর’ এই ভাবে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে যাওয়া একটু একটু করে।
আর তার পরেই ক্লাইম্যাক্স। শত শত ঢাকের একসঙ্গে বেজে ওঠা।
এর মধ্যে মহালয়াও আছে অবশ্য। মহালয়া না-হলে তো আর দুর্গাপুজো হতে পারে না। কিন্তু এ প্রজন্মের কাছে মহালয়া মানে কী? স্কুল ছুটি, কলেজ ছুটি, কিছু কিছু অফিস-কাছারিও ছুটি। তাই মহালয়ার দুপুরে শেষ রাউন্ড শপিংটা জমে ভালই, যদি বৃষ্টি বাগড়া না-দেয়। আর ছুটি বলেই আরও একটু ভিড় বাড়ে মলের ফুড কোর্টে, পাড়ার কফিশপে, পার্ক স্ট্রিটে। |
|
কিন্তু ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে বিছানায় শুয়ে শুয়ে তাই বলে রেডিয়োয় আগমনী শুনছে এ প্রজন্মের ছেলে- মেয়েরা, এ বদনাম তাদের কেউ দিতে পারবে না। যদি হঠাৎ করে নিজেদের সভ্যতার সংকটে দাঁড়িয়ে কোনও বাবা-মা ছেলেকে ডেকে দিয়ে বলেন “ওঠো, মহালয়া শুনবে। দেখো কী গেয়েছিলেন ওঁরা! সুপ্রীতি ঘোষ, সুমিত্রা সেন, দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়, পঙ্কজ মল্লিক। কী ভাবে স্ত্রোত্র পাঠ করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।” সেই আবেগ বাঙালি পঞ্চাশ বছর পরেও অতিক্রম করতে পারেননি। কিংবা যদি বলেন, “আমাদের পূর্বপুরুষ, তোমাদেরও পূর্বপুরুষ। তাই চলো ধুতি পরে গলা জলে দাঁড়িয়ে বাৎসরিক অন্ন-জল দান করবে চলো। তাঁদের আত্মা অপেক্ষায় আছে” সেই ছেলে ঘুমচোখ ডলতে ডলতে অবাক বিস্ময়ে তাকাবে, ভাববে মাথা খারাপ হল নাকি মায়ের? বাবার? “রাত আড়াইটে পর্যন্ত ফেসবুক করে সবে শুয়েছি। ব্র্যান্ড ফ্যাক্টরিতে যাব জিন্স আর জুতো কিনতে। হয় স্যাট-ক্যাট-ম্যাট পড়া আর নইলে মস্তি, আমাদের জীবনের এটাই সারমর্ম।
বিশ্বকর্মা, ঘুড়ি ওড়ানো, মহালয়া, পিতৃতর্পণ, মাতৃপক্ষ, শিউলি ফুল, কাশের দোল, ঢাকের বোল, নীল অপরাজিতা, একশো আটটা লাল পদ্ম, সন্ধিপুজো, বিসর্জনের সময় মা দুর্গার চোখ ছলছল এ সবই তো তোমাদের সেকেলে ম্যাজিক রিয়ালিজম। তোমরা সেই নিয়ে বুঁদ হয়ে আছ। থাকো। আমাদের স্পর্ধিত যৌবনের কাছে এ সব বাতিল হয়ে গেছে।”
ম্যাজিক রিয়ালিজমই তো বটে। আমরা ওদের ভ্যাম্পায়ারকে বিশ্বাস করিনি। ওরা কী করে বিশ্বাস করবে অসুরেরা রক্তবীজের বংশ? রক্তের ফোঁটা থেকে শত শত অসুর সৈন্য তৈরি হচ্ছে মা দুর্গার সঙ্গে যুদ্ধ করবে বলে। এই মিথের থেকে আরও আকর্ষণীয়, বুদ্ধিদীপ্ত সায়েন্স ফিকশন, জম্বি, ঘোস্ট, টোয়াইলাইট সিরিজ, এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল, রেসিডেন্স ইভিল আছে ওদের সম্ভারে। তখন তো মা বাঙালির ছেলেকে ইংরেজি ভাল করে শিখতে হবে বলে ঠাকুমার ঝুলি কেড়ে নিয়ে হাতে হ্যারি পটার গুঁজে দিয়েছিলে। আজ আর পেছন থেকে টেনে ধরলে চলে?
আমাদের দিদিমা-ঠাকুমারা বলতেন, “একটা দুর্গাপুজো শেষ হলে বাঙালি পরের দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি শুরু করে দেয়।” ঠিক যে ভাবে গভীর জলে সাঁতার কাটতে কাটতে মাঝে মাঝে লোকে মুখটা জল থেকে তুলে পাড় কত দূরে দেখে নেয়, বাঙালির ক্ষেত্রে বেঁচে থাকাটা ছিল যেন অনেকটা ওই রকম ভাবে সাঁতরাতে সাঁতরাতে কোনও এক দুর্গামণ্ডপের সামনে ঠিক বোধনের মুহূর্তে জল ছেড়ে উঠে এসে দম নেওয়া!
তিন দিন পর পর মেঘ আর বৃষ্টি দেখলেই শরতের নীল রৌদ্রকরোজ্জ্বল আকাশ দেখার বাসনা জেগে ওঠে বাঙালির মনে। হাঁটুর ব্যথা নিয়েও জুলাইয়ের মাঝখানে বাঙালি গিন্নি গড়িয়াহাট মার্কেট চষে ফেলেন পুজোয় কাকে কী দিতে হবে তার বিরাট লিস্ট হাতে। হ্যাঁ, সেই লিস্টে প্রাপ্তির তালিকায় এখনও লেখা হয় মেয়ের ননদের শাশুড়ির নাম। কেউ কেউ এখনও ছেলে-মেয়ে-বৌ নিয়ে দেড় ঘণ্টা বাস জার্নি করে হাতে এক বাক্স মিষ্টি নিয়ে পৌঁছে যান রাঙাপিসিমার বাড়ি বিজয়া করতে। দুর্গাপুজোর বিস্তার আর প্রসিদ্ধি আসলে তাবৎ বছর জুড়েই। মাত্র পাঁচ দিনের দুর্গাপুজো হলে সত্যিই কি আশ মিটত বাঙালির?
কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা বোধহয় অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে আমাদের জাতির যাবতীয় সমষ্টিগত আশা-আকাঙ্ক্ষা রোম্যান্টিকতা থেকে। বাঙালির যদি কোনও নস্ট্যালজিয়া হয়, তা হলে আমরা যে যতই চেষ্টা করি না কেন সেই নস্ট্যালজিয়ার ওপর একটা বাস্তবের আধিপত্য তৈরি করার, বিশেষত এই মহালয়া থেকে বিজয়া অবধি আমাদের সন্তানসন্ততিরা কিন্তু সেই উত্তরাধিকারকে নস্যাৎ করেই সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।
|
মহালয়া |
সেই সময় |
এই সময় |
• ভোরে রেডিয়োয় বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে মহালয়া শোনা
•
পুজো শুরুর ঘণ্টা পুজোর প্রস্তুতি ভিড় ঠেলে শপিং |
• ভোররাত অবধি ফেসবুক • স্রেফ ফুর্তি-ফার্তা
•
ইন্সটাগ্রামে ছবি পোস্ট
•
অনলাইন শপিং |
|
মডেল: কোয়েল ছবি: দেবাশিস মিত্র লোকেশন: ক্যালকাটা রেট্রো,
অ্যাক্সিস মল পোশাক: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য (দর্জি)
মেক আপ: অরুণ হেয়ার: মৌসুমী রূপায়ণ ও বিন্যাস: অরিজিৎ চক্রবর্তী |
|
|
|
|
|