জাল নোট শব্দটা যেন জীবনে প্রথম বার শুনলেন, এমন ভাবে তাকালেন দুই যুবক। কালো কষকষে পেটানো চেহারা। সন্দিগ্ধ দু’জোড়া চোখ।
প্রশ্ন ছিল, বাংলাদেশ থেকে এখানে কি জাল নোট ঢোকে? কারা সে সব নিয়ে আসে?
জাল নোট? না-না। এ রকম কোনও ব্যাপার এখানে নেই। আমরা বলতে পারব না।
কথা বলেই তাঁরা কিন্তু সরে গেলেন না। দুপুরে কুম্ভিরা গ্রামে ঢোকা ইস্তক ওই দু’জন সর্বদা গায়ে সেঁটে থেকেছেন। মুখে কোনও কথা নেই। ঠান্ডা, নিষ্পলক চাউনিতে নজরদারির উদ্দেশ্য সাফ।
জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) মাস ছয়েক আগে দিল্লি থেকে উজিয়ে গ্রামে এসে ধরে নিয়ে গিয়েছে কুম্ভিরা হাটের বাসিন্দা মান্নান শেখ ও বাদল শেখকে। কুম্ভিরার উপপ্রধান নিতাই ঘোষ বলেন, “আমরা জাল টাকা নিয়ে শঙ্কিত। কিন্তু আমাদের এলাকায় জাল টাকা বেশি পাওয়া যায় না। বেশির ভাগটাই চলে যায় ভিন রাজ্যে।” |
মালদহ শহর থেকে কুম্ভিরা প্রায় ৫০ কিলোমিটার। আর কুম্ভিরার আড়াই কিলোমিটারের মধ্যেই বাংলাদেশ সীমান্ত। গঙ্গার চর যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখানেই শোভাপুর গ্রাম। তার গা ঘেঁষে রয়েছে বাংলাদেশের গ্রাম রানিনগর ও পারজোকা। কুম্ভিরার একেবারে ও পারে বাংলাদেশের নবাবগঞ্জ জেলার মনকষা গ্রাম। চর ধরে জলা পেরিয়ে দিব্যি চলে যাওয়া যায় বাংলাদেশে। তারকাঁটা পেরোনোর ঝক্কি নেই, তোয়াক্কা করতে হয় না বিএসএফের অনুমতিরও। শোভাপুরে বিএসএফের একটি শিবির রয়েছে। রক্ষীদের টহলদারি রয়েছে ঠিকই, কিন্তু যে-সব জায়গায় কাঁটাতার নেই, সেখানে রাতের ঘন অন্ধকারে বেআইনি সীমান্ত পারাপারে বিশেষ বেগ পেতে হয় না।
সিআইডি-র বক্তব্য, বাংলাদেশ থেকে জাল নোট পাচার হয়ে আসার পক্ষে কুম্ভিরার মতো চরে অবস্থিত সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামগুলিই আদর্শ। সিআইডি-র এক কর্তা বলেন, “মালদহের চর এলাকার বিস্তীর্ণ অংশের ভৌগোলিক অবস্থান এমন, যে পুলিশি নজরদারি কিংবা বিএসএফের টহলদারি সেখানে নিয়মিত করাই সম্ভব নয়। আবার অনেক সময়ে নির্দিষ্ট খবরের ভিত্তিতে তল্লাশিতে গেলে বহু দূর থেকেই পুলিশকে দেখে সতর্ক হয়ে যায় অপরাধীরা।”
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের হিসেব অনুযায়ী, দেশে জাল টাকার ৭০ শতাংশই পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে ঢোকে। গত পাঁচ বছরে এ রাজ্যে প্রায় ১৭ কোটি টাকার জাল নোট ধরা পড়েছে। আবার রাজ্য পুলিশের হিসেবে, বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে যত জাল নোট ঢোকে, তার ৮০ শতাংশই ঢোকে মালদহের বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে। এ ক্ষেত্রে সব চেয়ে এগিয়ে এই জেলার কালিয়াচক ও বৈষ্ণবনগর থানা। এনআইএ-র এক অফিসার রসিকতার সুরে বলছিলেন, “মালদহের কালিয়াচক আর বৈষ্ণবনগর থানার সঙ্গে জাল নোটের ব্যাপারে যত বার যোগাযোগ করতে হয়, দেশের আর কোনও থানার সঙ্গে আমাদের তা করতে হয় না।”
দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলি মনে করে, ভারতের অর্থনীতিকে পঙ্গু করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ হয়ে ভারতীয় জাল নোট এ দেশে ঢোকাচ্ছে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। গোয়েন্দাদের হিসেব যত জাল নোট ধরা পড়ছে, তার অন্তত দশ গুণ ইতিমধ্যেই বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে।
পুলিশের বক্তব্য, একটা সময় জেলার সব চেয়ে বেশি অপরাধপ্রবণ এলাকা ছিল এই কালিয়াচক ও বৈষ্ণবনগর। এখনও তাই। শুধু অপরাধের ধরনটা বদলেছে। মারদাঙ্গা, খুনোখুনি, লুঠপাট কমে এখন বেড়ে গিয়েছে জালনোটের রমরমা কারবার। তা ছাড়া, মালদহ জেলায় বাংলাদেশের সঙ্গে ১৫৮ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ৪০ কিলোমিটারে কাঁটাতারের বেড়া নেই। ওই বেআব্রু সীমান্তের ২৫ কিলোমিটারই আবার গিয়েছে কালিয়াচক ও বৈষ্ণবনগরের ধার দিয়ে। আর তার সুযোগেই বিস্তীর্ণ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে যে বজ্র আঁটুনি, তার ফস্কা গেরো হয়ে উঠেছে মালদহের এই দুই থানা। |