|
|
|
|
আমরি-র আর্জি মেনে বার্তা শিল্পবন্ধু মমতারই |
পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় • কলকাতা |
প্রশাসনের অনুমোদন চেয়ে গত দেড় বছরে নয় নয় করে এগারোটি চিঠি লিখেছিলেন ওঁরা। জবাব ছিল একটাই ফাইল রয়েছে ম্যাডামের কাছে। তিনি সবুজ সঙ্কেত না-দিলে অনুমতি মিলবে না।
অবশেষে সবুজ সঙ্কেত মিলল। যাকে নতুন এক পরিবর্তনেরও সঙ্কেত বলে মনে করছেন রাজ্য প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। ওঁদের দাবি, আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টির সঙ্গে আমরি হাসপাতালের তিনটি ভবন (মেন বিল্ডিং, অ্যানেক্স-টু এবং আমরি ডায়াবেটিক ক্লিনিক তথা নার্সিং ট্রেনিং স্কুল) পুনরায় চালু করতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জড়িয়ে থাকলেও এর মাধ্যমে আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বোঝাতে চাইলেন, রাজ্যের শিল্পে বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে আগের ভাবমূর্তি অনেকটাই ঝেড়ে ফেলে কার্যত ‘শিল্পবন্ধু’-র ভূমিকা নিতে চলেছেন তিনি।
বস্তুত গত অগস্টে মুম্বইয়ের শিল্প সম্মেলন পরবর্তী অধ্যায়ে শিল্পায়ন উদ্যোগের প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ভাবমূর্তি যে খানিকটা ‘অন্য রকম’ হয়ে উঠেছে, প্রশাসন ও শিল্প-বাণিজ্যমহলের একাংশের কথায় তারই ইঙ্গিত। এই মহলের মতে, মমতার বর্তমান ভূমিকা আগের তুলনায় অনেকটা বাস্তববাদী, যেন পরিণত কোনও ব্যাটসম্যানের দ্বিতীয় ইনিংস।
এ প্রসঙ্গে ‘প্রথম ইনিংসের’ স্মৃতিও উঠে আসছে। তাঁর আন্দোলনের জেরে টাটার ন্যানো কারখানা সিঙ্গুর থেকে পাততাড়ি গোটানোর পরে রাজ্যের তদানীন্তন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গায়ে সেই যে ‘শিল্পবিরোধী’ তকমা লেগে গিয়েছিল, ক্ষমতায় এসে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসার পরেও তা মোছেনি। “আমরি-কাণ্ডের পরবর্তী দেড় বছর তা বহাল ছিল। ইদানীং ধীরে ধীরে সেটা বদলাতে শুরু করেছে। আমরি’র তিনটি ভবন চালুর অনুমতি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী আবার সেটাই বোঝালেন।” মন্তব্য মহাকরণের এক অফিসারের। |
|
২০১১-র ৮ ডিসেম্বর গভীর রাতে আগুন লেগেছিল ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতালের ‘অ্যানেক্স-ওয়ান’ ভবনে (ঠিকানা: ১৫, পঞ্চাননতলা রোড)। ৯১ জনের মৃত্যু হয়। পুড়ে যাওয়া বাড়িটির লাইসেন্স তো বাতিল হয়ই, আশপাশে থাকা আমরি-র আরও তিনটে ভবনেরও লাইসেন্স সাসপেন্ড করে দেয় স্বাস্থ্য দফতর। বাড়ি তিনটি হল: মেন বিল্ডিং (পি-৪ সিআইটি স্কিম, গড়িয়াহাট রোড), অ্যানেক্স-টু (১৭, পঞ্চাননতলা রোড) এবং ডায়াবেটিক ক্লিনিক (৩৮/১এ, গড়িয়াহাট রোড)। ২০১১-র ১৩ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য দফতরের সংশ্লিষ্ট নির্দেশিকায় বলা হয়: পরবর্তী নির্দেশ পর্যন্ত বাড়ি তিনটিতে
চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় কাজকর্ম বন্ধ রাখতে হবে।
মহাকরণের ইঙ্গিত, আমরি-কাণ্ডের পরে মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে হাসপাতালটির পরিচালনমণ্ডলীর সদস্যদের গ্রেফতারে সচেষ্ট হয়েছিলেন এবং স্বাস্থ্য দফতর যে ভাবে হাসপাতালটির অন্যান্য ভবনে কাজ আটকে দিয়েছিল, তাতে শিল্পমহলে বিরূপ বার্তা পৌঁছাতে থাকে। এক কর্তার কথায়, “তখন স্বাস্থ্য দফতরের তরফে বলা হচ্ছিল যে, মামলার নিষ্পত্তি না-হলে আমরি’র হাসপাতাল-বাড়িগুলো খোলার অনুমতি মিলবে না। ফলে বিশেষত অবাঙালি ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের একাংশের কাছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সম্পর্কে ভুল বার্তা যাচ্ছিল।” এমনকী, আমরির পরিচালক দু’টি শিল্পসংস্থা পশ্চিমবঙ্গে কারবার সম্প্রসারণের পরিকল্পনাও স্থগিত করে দেয় বলে সরকারি সূত্রের খবর।
মেন বিল্ডিং, অ্যানেক্স-টু ও ডায়াবেটিক ক্লিনিক খুলতে চেয়ে গত দেড় বছরে স্বাস্থ্য দফতরে মোট ১১টি চিঠি লিখেছেন আমরি-কর্তৃপক্ষ। তাঁদের দাবি, তিনটি ভবন পরিদর্শন করে সুরক্ষা-পরিস্থিতি যাচাই করে নেওয়ার জন্য প্রতিটি চিঠিতে স্বাস্থ্য-কর্তাদের অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু কোনও সাড়া মেলেনি। বরং স্বাস্থ্য-কর্তাদের জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তর এসেছে, “ফাইল ম্যাডামের কাছে। সেখান থেকে নির্দেশ না-পেলে আমরা পরিদর্শন করতে পারব না।” সরকারের এ হেন মনোভাবের সঙ্গে স্বাস্থ্য দফতরেরই একাধিক কর্তা সহমত হতে পারেননি। “পোড়া বাড়ির লাইসেন্স বাতিলের যুক্তি আছে। বাকিগুলো কেন বন্ধ থাকবে?ওখানে দামি যন্ত্রপাতি স্রেফ পড়ে পড়ে নষ্ট হয়েছে।” মন্তব্য এক কর্তার। তাঁর আক্ষেপ, “এতে বহু রোগী ও কর্মী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। মার খেয়েছে বিনিয়োগও।”
তবে পরিস্থিতি আচমকা বদলে গিয়েছে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্যভবন ওখানে পরিদর্শকদল পাঠায়। পরিদর্শকেরা দফতরকে রিপোর্ট দিয়ে জানিয়েছেন, ‘আমরির ওই তিনটি বাড়ি খোলায় আপত্তির কারণ দেখা যাচ্ছে না। সেগুলো ফের চালু হতেই পারে।’ ফলে আনুষ্ঠানিক কিছু প্রক্রিয়া ছাড়া ওখানে কাজ শুরুর পথে কার্যত বাধা নেই বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য-কর্তারা। সেই পরিদর্শন যখন হলই, এত দিন বাদে হল কেন?
রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর ব্যাখ্যা, “মহাকরণের নির্দেশ না-আসা পর্যন্ত আমাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব হয়নি। নিরাপত্তার সব শর্ত মানা হয়ে থাকলে জবরদস্তি কোনও হাসপাতাল বন্ধ করে রাখার অভিপ্রায় আমাদের নেই।” অন্য দিকে আমরি-সূত্রের বক্তব্য: যা যা দেখে সন্তুষ্ট হয়ে স্বাস্থ্য দফতর ছাড়পত্র দিতে চলেছে, সেই সব কাজ আগেই সারা হয়ে গিয়েছিল। আমরি গোষ্ঠীর তরফে দাবি করা হয়েছে, ঢাকুরিয়ায় তাদের হাসপাতালের চারটি বাড়িতে যন্ত্রপাতি ও অত্যাধুনিক শয্যা মিলিয়ে প্রায় দু’শো কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট হচ্ছে। কিছু যন্ত্রপাতি সারাতেই লাগবে অন্তত কুড়ি কোটি। উপরন্তু অফিসার, হাউসকিপিং-কর্মী ও করণিক মিলিয়ে প্রায় আটশো জনকে কার্যত বসিয়ে মাইনে দিতে হচ্ছে। এতে গত বাইশ মাসে প্রায় ৫০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে বলে দাবি করেছেন আমরি-প্রধান শ্রবণ তোদি।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে আমরি-কর্তৃপক্ষ আশাবাদী। “খবর পেয়েছি, তিনটি ভবন পরিদর্শন করে স্বাস্থ্য-কর্তারা সন্তুষ্ট। আশা রাখছি, শিগগিরই সেখানে কাজ শুরু হবে।” বলেছেন শ্রবণ। তিনি জানাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গে আমাদের অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। রাজারহাটে প্রায় পাঁচশো কোটি টাকায় পাঁচশো বেডের স্টেট অফ আর্ট হাসপাতাল হওয়ার কথা। বর্ধমানেও একই রকম হাসপাতাল গড়ার পরিকল্পনা আছে। ঢাকুরিয়ার তিনটে বিল্ডিং আনুষ্ঠানিক ছাড়পত্র পেলেই ওই সব কাজে হাত পড়বে।
প্রসঙ্গত, রাজ্যে প্রথম সারির বেসরকারি হাসপাতালের সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ হসপিটালস অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’ কিছু দিন আগে জানিয়েছিল, ঢাকুরিয়ার আমরি ফের চালু করার জন্য তারা সরকারকে লাগাতার অনুরোধ জানাচ্ছে। হাসপাতালটি বন্ধ থাকার দরুন কর্তৃপক্ষকে ফি মাসে যে বিপুল লোকসান গুনতে হচ্ছে, অ্যাসোসিয়েশনের তরফে সে ব্যাপারেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। মহাকরণের একাংশের মতে, এমতাবস্থায় আমরি’কে সবুজ সঙ্কেত দেওয়া মানে শিল্পমহলকে স্বস্তি দেওয়া। পাশাপাশি তা সরকারের শিল্পবন্ধু ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল করবে, যাতে প্রশস্ত হবে রাজ্যে লগ্নির রাস্তা।
আর সেই সুবর্ণ সুযোগ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এই মুহূর্তে হাতছাড়া করতে চায় না বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের একাধিক বড়কর্তা। |
|
|
|
|
|