রাজ্যে পরিকাঠামো উন্নয়নে কাজের যা চাপ, সেই তুলনায় সরকারের বিভিন্ন দফতরে ইঞ্জিনিয়ারের সংখ্যা কম। এ কথা জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার সায়েন্স সিটিতে ইঞ্জিনিয়ারদের এক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “রাজ্যের পূর্ত, আবাসন ও সেচ দফতরে ইঞ্জিনিয়ারদের উপরে কাজের চাপ অনেক বেশি। আপনাদের কাছে ইঞ্জিনিয়ার থাকলে দিন। অবসরপ্রাপ্ত হলে অসুবিধা নেই। পঁচাত্তর বছর বয়স হলেও চলবে।”
মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যে সংশ্লিষ্ট নানা মহলে নানা প্রশ্ন উঠেছে। তা উস্কে দিয়েছে বিতর্কও। রাজ্যের সরকারি ইঞ্জিনিয়ারদের সংগঠন, বণিকসভা এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তারা মনে করছেন, পশ্চিমবঙ্গে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ারের অভাব নেই। আবার সরকারের বিভিন্ন দফতরেও ইঞ্জিনিয়ারের বহু পদ খালি। অথচ চাহিদা-জোগানে সেতুবন্ধন না-হওয়ায় সমস্যা থেকে যাচ্ছে। সরকারের কাজের চাপ বাড়লেও সামাল দেওয়ার মতো ইঞ্জিনিয়ারের অভাব হচ্ছে। যার জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) মারফত নিয়োগের সাবেক ব্যবস্থার দিকেও আঙুল তুলছে প্রশাসন ও শিক্ষকমহলের একাংশ। তাদের মতে, বেসরকারি সংস্থার মতো কলেজে গিয়ে ‘ক্যাম্পাসিং’ করে ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ করা যায় কি না, রাজ্য সরকারের তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।
এ দিন সায়েন্স সিটিতে ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর ব্রিজ অ্যান্ড স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ আয়োজিত সম্মেলনটির মূল আলোচ্য ছিল, আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে সেতু, আবাসন ও রাস্তাঘাট কী ভাবে বানানো সম্ভব। সংগঠনের সভাপতির কথায়, কলকাতায় হাওড়া ব্রিজ ও বিদ্যাসাগর সেতুর মতো দুটো গুরুত্বপূর্ণ সেতু রয়েছে। শহরের কিছু নির্মাণ দেখার মতো। সেই কারণে সম্মেলনরস্থল হিসেবে কলকাতাকে বেছে নেওয়া হয়েছে। আর সেই সম্মেলনেরই উদ্বোধনী বক্তৃতায় সরকারি দফতরে ইঞ্জিনিয়ার ঘাটতির কথা শোনা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর মুখে। যে প্রসঙ্গে সরকারি ইঞ্জিনিয়ার সংগঠন ‘ফেটো’র এক কর্তা বলছেন, “সত্তরের দশকের পরে রাজ্যে ইঞ্জিনিয়ার ক্যাডারের সংখ্যা বিশেষ বাড়েনি। কিন্তু গত চার দশকে সরকারের কাজ বেড়েছে বিস্তর।” যদিও ইঞ্জিনিয়ারের অভাবে কাজ আটকে থাকার কথা তিনি মানতে চাননি। |
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে সরকারের নিয়োগ পদ্ধতি নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লেসমেন্ট আধিকারিক সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “যাদবপুর থেকে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়ারা প্রায় সকলে ক্যাম্পাসিংয়ে চাকরি পেয়ে যান। সিংহভাগ যান অন্য রাজ্যে বা বিদেশে। কারণ, সরকারি বলতে ক্যাম্পাসিংয়ে আসে একমাত্র রাজ্য বিদ্যুৎ সংস্থা। সরকার ক্যাম্পাসিংয়ে না-এলে ইঞ্জিনিয়ার পাবে কী করে?” যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রাক্তন ডিন নীতীন সোমের বক্তব্য, “এখন বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সংখ্যা বাড়ায় ফি বছর প্রচুর ছেলেমেয়ে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বেরোন। অধিকাংশ যান বেসরকারি সংস্থায়। সরকারি ক্ষেত্রে পূর্ত, সেচ, জনস্বাস্থ্য কারিগরি ও পুরসভায় সামান্য কিছু ইঞ্জিনিয়ার নেওয়া হয়।” শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি (বেসু)-র উপাচার্য অজয় রায় বলেন, “নির্মাণ শিল্পে প্রচুর কাজ হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্র মিলিয়ে অনেক সিভিল ইঞ্জিনিয়ার প্রয়োজন। এ রাজ্যে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে কেউ বসে থাকে না।” শিল্পসংস্থা সিমপ্লেক্স-এর অন্যতম কর্তা রাঘব মুন্দ্রার মন্তব্য, “দেশের কৃতী ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে অনেকে পশ্চিমবঙ্গের। এ রাজ্য দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার গড়ে বেশি। অথচ ওঁঁরা নিজের রাজ্যে থাকতে চান না!”
রাজ্য প্রশাসনের একাধিক কর্তা জানিয়েছেন, সরকারি দফতরে ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ হয় পিএসসি মারফত। প্রক্রিয়াটির দীর্ঘসূত্রতায় নিয়োগে বছর গড়িয়ে যায়। ফলে কাজের চাপ বাড়লেও অভাব থেকে যাচ্ছে। দৃষ্টান্ত সেচ দফতর। মহাকরণের তথ্য বলছে, সেচে এই মুহূর্তে অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারের ৩০% পদে লোক নেই। সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারের ২২% পদ ফাঁকা। যাঁরা আছেন, তাঁদেরও প্রায় অর্ধেককে পঞ্চায়েত ভোটের কাজে তুলো নেওয়া হয়েছিল। তাঁরা ফিরে এসেছেন ঠিকই, কিন্তু এখন আবার বর্ষার কারণে সেচের কাজ প্রায় বন্ধ।
সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় পরিস্থিতি সম্পর্কে বিলক্ষণ অবহিত। তিনিও মনে করেন, মান্ধাতার আমলের নিয়োগ প্রক্রিয়াটিকে বিদায় দিলে একটা সুরাহা হতে পারে। “পিএসসি-র মাধ্যমে ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ করতে প্রচুর সময় লেগে যায়। এটা বদলালে আখেরে সরকারেরই লাভ।” মন্তব্য মন্ত্রীর। তাঁর মতে, বিকল্প হিসেবে ক্যাম্পাসিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগের প্রস্তাব ভেবে দেখা যেতে পারে। আর সরকারি যে দফতরটির ইঞ্জিনিয়ার দরকার পড়ে সবচেয়ে বেশি, সেই পূর্তের মন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদার বলেন, “জঙ্গলমহল থেকে দার্জিলিং সর্বত্র রাস্তা, কলেজ, হাসপাতাল, স্টেডিয়াম গড়া হচ্ছে। বাঁধা সময়ের মধ্যে সেগুলো শেষ করতে যত দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার দরকার, তার অভাব আছে। প্রশাসন চিন্তিত।” মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য দাবি করেছেন, ইঞ্জিনিয়ারের অভাব থাকলেও পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজে গতি এসেছে। এ দিন তিনি বলেন, “আগে কোনও প্রকল্পের বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি করতে ছ’মাস লেগে যেত। টেন্ডার ডাকতে আরও কয়েক মাস। এখন ই-টেন্ডার চালু হওয়ায় জোরদার কাজ হচ্ছে। এতে দুর্নীতিও রোখা গিয়েছে অনেকটা।”
একই সঙ্গে মমতা ফের জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি উচ্ছেদ করে উন্নয়ন করার বিরোধী। “কখনও কখনও বলা হয়, জবরদখল থাকায় কাজ হচ্ছে না। এটা ঠিক নয়। ওঁদের রেখেই ঠিক ভাবে পরিকল্পনা করে উন্নয়নের কাজ করা যায়।” মন্তব্য তাঁর। এ প্রসঙ্গে তিনি বনগাঁয় জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণ আটকে থাকার প্রসঙ্গটি তোলেন। সম্মেলনে উপস্থিত ইঞ্জিনিয়ারদের উদ্দেশ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “গ্রামের পথ ঘুরেই রাস্তার হাল জানা যায়। বোঝা যায় সেতুর অবস্থা। তাই প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে জেলায় জেলায় যাচ্ছি। প্রশাসন কী কাজ করছে, তা যাচাই করতে পারছি।” |