অর্থনীতিবিদ সুগত মারজিৎ রাজ্য উচ্চশিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান পদটি ত্যাগ করিলেন। শিক্ষামন্ত্রী জানাইয়াছেন, পরবর্তী চেয়ারম্যান নিয়োগের প্রক্রিয়া এখনই শুরু হইতেছে না। অতএব, অনুমান করা চলে, এই মুহূর্তে শিক্ষামন্ত্রীর হাতে খানিক সময় আছে। এই অবসরে তাঁহাকে একটি প্রশ্ন লইয়া ভাবিতে বলিলে তাঁহার প্রতি অবিচার হইবে না। প্রশ্ন: উচ্চশিক্ষা সংসদ আদৌ কেন থাকিবে? শুনিয়া শিক্ষামন্ত্রী অবাক হইতে পারেন, কিন্তু তাহা অভ্যাসের দোষ। দীর্ঘদিনের অভ্যাস। এবং কু-অভ্যাস। মন্ত্রিবর, এবং তাঁহার সরকারের প্রধান হয়তো সর্বদা খেয়াল করেন না, অন্য নানা বিষয়ের মতোই এই জাতীয় সংসদের ধারা বজায় রাখিয়া তাঁহারা আসলে অতি নিষ্ঠাভরে বামপন্থীদের ‘ঐতিহ্য’ বহন করিতেছেন। বিভিন্ন কমিটি ইত্যাদি গঠনে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের সবিশেষ উৎসাহ ছিল, কারণ এই কমিটিগুলি শিক্ষার সর্বস্তরে দলতন্ত্রের শিকল আঁটিয়া রাখিতে বিশেষ সহায়ক হইত। সর্বশক্তিমান হইবার এই বামপন্থী বাসনাটি বর্তমান শাসকরা উত্তরাধিকার সূত্রে পাইয়াছেন। সি পি আই এমকে পরাজিত করিয়া তাঁহারা ক্ষমতায় আসিয়াছেন এবং সি পি আই এমের মানসিক উত্তরাধিকার বহন করিয়া চলিতেছেন, নিজেদের অজ্ঞাতসারেই হয়তো বা।
এক শিক্ষাকর্তা বলিয়াছেন, উচ্চশিক্ষা সংসদ শিক্ষার নীতি বিষয়ে কথা বলিতে পারে, কিন্তু তাহা বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনন্দিন কাজেও ঢুকিয়া পড়িতে চাহিয়াছে। তাহা অনেকের নিকটই আপত্তিকর ঠেকিয়াছে। বক্তব্যের দ্বিতীয় ভাগ যথার্থ, প্রথম ভাগটি নহে। সংসদই যদি শিক্ষা নীতি স্থির করিবে, তবে আর মন্ত্রীর প্রয়োজন কী? নীতি স্থির করাই তো তাঁহার একমাত্র কর্তব্য হওয়ার কথা। আর, বিশ্ববিদ্যালয় কী ভাবে চলিবে, সেই সিদ্ধান্ত করিবার অধিকার একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসকদের। তাহাতেও সংসদের হস্তক্ষেপের জায়গা নাই। তবে, সংসদটি আছে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর অনেকেই জানেন। সেই উত্তরের সহিত শিক্ষার সম্পর্ক নাই।
কোন বিশ্ববিদ্যালয় কী ভাবে চলিবে, কোন কলেজের কর্মপদ্ধতি কী হইবে, তাহা স্থির করিয়া দেওয়া সরকারেরও কাজ নহে। সত্য, সরকার উচ্চশিক্ষা বাবদ অর্থ ব্যয় করে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সেই অর্থের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু সরকারের কাজ টাকা দেওয়াতেই শেষ। টাকা দিয়াছি বলিয়া মতামতও দিব এই বিচিত্র বাসনাটি অযৌক্তিক। প্রতিটি কলেজ স্বশাসিত হইবে, তাহাই আদর্শ পরিস্থিতি। কোন কলেজ কোন পথে চলিবে, তাহা স্থির করিবেন সেই কলেজের অধ্যক্ষ, শিক্ষক সমাজ, পরিচালন সমিতি এবং ছাত্ররা। কোনও কলেজ বিপথগামী হইতেই পারে। বাজারের নিয়মেই সেই কলেজটি তাহার জায়গা হারাইবে। অথবা, শিক্ষক, ছাত্র ও অভিভাবকদের সচেতন উদ্যোগে তাহা আবার গুণগত উৎকর্ষের সাধনায় ফিরিবার চেষ্টা করিবে। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হইবার দায় সরকারের নাই। এই রাজ্যে সরকার যাচিয়া সেই দায় লইয়াছে, কারণ তাহাতে শিক্ষার পরিসরে সরকারি তথা দলীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করিতে সুবিধা হয়। কিন্তু, দলীয় কার্যালয় হইতে শিক্ষাক্ষেত্র পরিচালনা করিলে তাহার ফল কী রূপ ভয়াবহ হইতে পারে, বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গে তাহার অনপনেয় উদাহরণ স্থাপন করিয়া গিয়াছে। তাহাতে কি যথেষ্ট হয় নাই? সেই একই ছবির তৃণমূল কংগ্রেসি সংস্করণ প্রকাশ করিতেই হইবে? প্রকৃত পরিবর্তন-এর জন্য কি আরও চৌত্রিশ বছর অপেক্ষা করিতে হইবে? |