ভারতে রাজনীতির মেরুকরণ এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছাইয়াছে যে, সেনাবাহিনীর প্রধানদের লইয়াও রাজনীতির দড়ি-টানাটানি চলিয়াছে! অবসরপ্রাপ্ত সেনাধ্যক্ষ ভি কে সিংহ তাহার জ্বলন্ত প্রমাণ। তিনি যখন স্থলবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন, তখনই তাঁহার বয়স, অবসরের তারিখ, চাকুরির মেয়াদের সম্প্রসারণ ইত্যাদি লইয়া অনাবশ্যক কাজিয়া শুরু হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সহিত তাঁহার দ্বন্দ্ব সুপ্রিম কোর্ট অবধি পৌঁছায়। এই পর্বেই সেনাবাহিনীকে নিকৃষ্ট মানের ফৌজি ট্রাক বেচিবার জন্য সেনাপ্রধানকে উৎকোচ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও সামরিক বিভাগের আমলাদের কথাবার্তা লুকাইয়া শোনা এবং তাঁহাদের উপর নজরদারির অভিযোগও ওঠে সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে। তিনি অবসর লওয়ার পরও বিতর্ক তাঁহার ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের পিছু ছাড়ে নাই। নূতন অভিযোগভি কে সিংহ নাকি অনুগত অফিসারদের দিয়া জম্মু-কাশ্মীরের নির্বাচিত সরকারকে গদিচ্যুত করিতে ও সেনাবাহিনীতে তাঁহার উত্তরসূরির অভিষেক বানচাল করিতে বিপুল অর্থের সংস্থানও করেন। অভিযোগগুলি ক্রমাগত প্রকাশ্যে আসিয়াছে, কিন্তু এ-যাবৎ সেগুলির যাথার্থ্য সম্পর্কে যথোচিত তদন্তের ব্যবস্থা হয় নাই, অন্তত হইয়াছে কি না, তাহা স্পষ্ট নহে।
অথচ যখন প্রাক্তন সেনাপ্রধান বিরোধী দল বিজেপিতে যোগ দিয়া বিজেপি নেতৃত্বের সহিত এক মঞ্চে আত্মপ্রকাশ করিয়াছেন, পত্রপাঠ তাঁহার বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ আসিয়াছে। সদ্য-অবসৃত সেনাপ্রধানকে লইয়া দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক মেরু টানাটানি করিতেছে এমন সংশয় কি নিতান্ত স্বাভাবিক নহে? প্রতিরক্ষা মন্ত্রক তথা ইউপিএ সরকারের অস্বস্তি বাড়াইয়া ভি কে সিংহ বিরোধী রাজনীতির শরিক হওয়াতেই যে তাঁহার বিরুদ্ধে সিবিআইকে সক্রিয় করা হইল, এমন জল্পনা কাল্পনিক নয়। আর এখানেই উদ্বেগ। সেনাবাহিনীকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখার যে ঐতিহ্য ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগের উত্তরাধিকার হিসাবে সযত্নে লালিত, তাহা বিপজ্জনক ভাবে লঙ্ঘন করা হইতেছে। ভারত কিন্তু পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ নয়, যেখানে সেনা-ছাউনি হইতে প্রায়শ রাষ্ট্রনায়করা উঠিয়া আসেন। এই গণতন্ত্রে সামরিক বাহিনী সর্বতোভাবেই অসামরিক রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের অধীন এবং আজ্ঞাবহ। সীমান্ত প্রহরা ছাড়া এই বাহিনী কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলার সময়েই ছাউনির বাহিরে আসে। কখনও-সখনও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা প্রশমনে স্পর্শকাতর এলাকায় রুট-মার্চ করিতে এবং পুলিশকে সাহায্য করিতে তাহাদের তলব করা হয়, যদিও তাহাও নীতিগত ভাবে বিধেয় নহে। দেশবাসী যে সামরিক বাহিনীর এই অরাজনৈতিক চেহারাটি দেখিতে অভ্যস্ত, ইহাই এ দেশে তাহার অবস্থানকে নির্দিষ্ট করিয়া দেয়। প্রাক্তন সেনাপ্রধানকে লইয়া দুই প্রধান দলের মধ্যে রাজনীতির খেলা কি সেই ভূমিকা অস্পষ্ট করিয়া দিবে না?
ভি কে সিংহ যে সর্বদা তাঁহার পদমর্যাদার সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ করিয়াছেন, এমন নহে। তাঁহার তরফেও বিচ্যুতি ঘটিয়াছে। তিনি যে গোটা বাহিনী, বস্তুত সমগ্র দেশবাসীর কাছেই এক আদর্শ স্থাপনে দায়বদ্ধ, ইহা হয়তো তিনি খেয়াল রাখেন নাই। কিন্তু তাঁহার প্রতি সরকার, বিশেষত প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের আচরণেও অনৈতিকতা আছে, এমনকী প্রতিশোধপরায়ণতার সংকেতও, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নিকট যাহা প্রত্যাশিত নয়। ভি কে সিংহের তরফে কোনও স্খলন, অনিয়ম বা দুর্নীতি হইয়া থাকিলে অবশ্যই তাহার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হওয়া চাই এবং দ্রুত সেই তদন্ত হউক। কিন্তু তিনি যদি সংশয়-সন্দেহের ঊর্ধ্বে হন, তবে কেবল বিরোধী দলের সহিত ওঠাবসা করিতেছেন বলিয়াই তাঁহার বিরুদ্ধে সিবিআই তৎপর হইবে, ইহা আপত্তিকর। বিপজ্জনকও। |