প্রতিদিন হাঁড়িতে ভাত চাপানোর আগে ছোট্ট একটা মাটির ভাঁড়ে আলাদা করে এক মুঠো চাল সরিয়ে রাখেন বধূ লক্ষ্মী ঘোষ, সাবিত্রী কর্মকার, রিঙ্কু মণ্ডলরা। শুধু ওঁরা নন, গোটা গ্রামেরই এক রেওয়াজ। উদ্দেশ্য, জমানো ওই চাল বিক্রির টাকায় গ্রামের একমাত্র দুর্গাপুজো করা। এখনও একই ভাবে পুজোর টাকা জোগাড় করেন খয়রাশোলের ভাড্ডি গ্রামের বাসিন্দারা।
কেন এই রীতি চালু হল? বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, এক বৈষ্ণব সাধু প্রচলিত প্রাচীন এই দুর্গাপুজো পরিচালনার ভার ছিল জনা কয়েক সেবাইতের উপর। সেই সময় এই গ্রামের লোকসংখ্যা ছিল কম। মূলত কৃষিনির্ভর এই গ্রামের বাসিন্দাদের আয়ও সীমিত ছিল। এ হেন অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সেবাইতদের পক্ষে দুর্গাপুজোর খরচ চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। সময়কাল ষাটের দশকের। তারপর ওই গ্রামেরই একটি পরিবার পুজোর খরচ চালানোর জন্য একটি কৃষিজমি দান করেন। জমি থেকে আয়ে পুজো চলতে থাকে। তবে সেই সময় থেকেই গ্রামের কিছু যুবক ওই পুজোয় সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন। ধীরে পুজোটি গোটা গ্রামের পুজোয় পরিণত হতে থাকে। সাতের দশকের শেষের দিকে ভূমি সংস্কার বা বর্গা আইনের আওতায় মন্দিরের জমিটি চলে আসার পরে ফের আয় কমতে থাকায় সমস্যা তৈরি হয় পুজোর খরচ চালানো নিয়ে। তখনই এক মুষ্টি চাল রেখে পুজোর খরচ চালানোর ভাবনার সূত্রপাত। |
গ্রামের বাসিন্দা নারায়ণ কর্মকার, অসীম শীলদের কথায়, “এক মুখো চাল রাখার পরিকল্পনা শুধু দুর্গাপুজো নয়, গ্রামের ধর্মরাজ পুজোর খরচ চালানো থেকেই এসেছিল। পরে তা পুরোপুরি দুর্গাপুজোর জন্যই খরচ করা হয়ে থাকে।” বর্তমানে অবশ্য দুর্গা পুজোর দায়িত্বে থাকা সেবাইতদের কেউ বেঁচে নেই বলে গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন। তবে পুজোর খরচ নিয়েও সেই সমস্যা নেই। এখন পুজো কমিটি তৈরি করেছেন গ্রামেরই যুবকেরা। গত কয়েক বছর ধরে বাড়িতে বাড়িতে চাঁদাও সংগ্রহ করা হয়। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গ্রামের কেউ না কেউ এখন প্রতিমার খরচ দিয়ে থাকেন। তাই খয়রাশোলের ভাড্ডি গ্রামের দুর্গাপুজো বেশ জাঁকজমকপূর্ণ।
তবে একদা চালু হওয়া প্রতিদিন এক মুঠো চাল আলাদা করে সরিয়ে রাখা রীতি ও সেই জমানো চাল থেকে যে আয়, তার উপর বেশ কিছুটা নির্ভরতা রয়েছে। কমিটির মূল দায়িত্বে থাকা রমেশ মিশ্র, উজ্জ্বল গোপরা বলেন, “কমিটির তরফে গ্রামের ১৬৫টি পরিবারকে একটি মাটির ভাঁড় দেওয়া হয়েছে। প্রতি বাড়িতে গিয়ে প্রতি রবিবার জমানো চাল সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন কমিটির সদস্যরা। সপ্তাহে প্রায় ৬০ কিলোর মতো চাল সংগ্রহ করা হয়। কেজি প্রতি গড়ে ২০টাকায় বিক্রি করে সেই টাকা জমিয়ে রাখা হয় (বছরের হিসেবটা প্রায় ৬০ হাজার)।”
এ ভাবেই এক সময়ের টিনের চালা দুর্গা মণ্ডপ বদলে গত বছর চকচকে পাকা মন্দির হয়েছে। দুর্গা মন্দিরের এক পাশে ধর্মরাজ মন্দির। প্রতিমা তৈরি হচ্ছে সামনের নাটশালায়। মাটির কাজ শেষ হয়ে গেলেও কচিকাঁচাদের আড্ডা এখন ওখানেই। মাত্র আর কটাদিন মাঝে। পুজো শেষ হলে আবার পরের বছরের প্রস্তুতি। |