|
|
|
|
বাড়ির উঠোন ফেটে ঢুকে গেলেন তরুণী |
সুশান্ত বণিক • আসানসোল |
বাড়ির উঠোন ফাটিয়ে কয়লা খাদান গিলে নিল এক তরুণীকে।
বাড়ির লোকজন নড়ার সুযোগ পেল না। আচমকা ফেটে ফাঁক হয়ে গেল মেঝে। ফুট তিনেক ব্যাসের গর্ত থেকে লাফিয়ে উঠল ধোঁয়া আর আঁচ। পাতালপ্রবেশের আগে চিৎকার করার সময়টুকুও পেলেন না তরুণী।
বৃহস্পতিবার রাত ৮টা নাগাদ যেখানে লহমায় ঘটনাটি ঘটে যায়, আসানসোলের সেই সাঁকতোড়িয়াতেই কয়লা খননের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থা ইস্টার্ন কোলফিল্ডস লিমিটেডের (ইসিএল) সদর দফতর। ২০১২ সালেও ওই এলাকায় ইসিএলের বাংলোয় ধস নেমেছিল।
এ দিন ঘটনাটি ঘটে সাঁকতোড়িয়া কলোনির মুখে ১২ নম্বর বস্তিতে। তার উল্টো দিকেই ইসিএলের ফুটবল মাঠ ‘সাঁকতোড়িয়া গ্রাউন্ড’। এলাকার লোকজন বলছেন, দুপুর ৩টে নাগাদই তাঁরা বোঝেন যে মাটি কাঁপছে। তখনই মনে হয়েছিল, খারাপ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। তবে যেহেতু ওই এলাকায় মাঝে-মাঝে মাটি কাঁপে, তাই ততটা আতঙ্কও ছড়ায়নি। কিন্তু রাতে আচমকা যা ঘটল, তা কারও কল্পনারও বাইরে ছিল।
সাঁকতোড়িয়া ১২ নম্বর বস্তির বাড়িটিতে এ দিন সন্ধ্যেটা আর পাঁচটা সন্ধ্যের মতোই ছিল। বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিলেন বছর বিশেকের হেনা পারভিন। কাছে খাটিয়ায় বসে ছিলেন তার বাবা, পেশায় দিনমজুর মুক্তার আনসারি। মা ছিলেন ঘরে। মুক্তারের কথায়, “হঠাৎ বিকট শব্দে মাটি ফেটে হাঁ হয়ে গেল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওই হাঁ-মুখে ঢুকে গেল মেয়েটা!” |
|
উঠোনের সেই গর্ত থেকে বেরোচ্ছে ধোঁয়া। সাঁকতোড়িয়ায়। ছবি: শৈলেন সরকার। |
গর্ত দিয়ে তখন গলগল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত বাদে সংবিত ফিরতেই মুক্তার চিৎকার করে বস্তির লোকজনকে ডাকতে থাকেন। ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসেন হেনার মা-ও। মাটির নীচে আগুনের আঁচ আর ধোঁয়ার তীব্র গন্ধে উঠোনে তখন দাঁড়ানো যাচ্ছে না। হেনাকে উদ্ধারের চেষ্টা করবেন কী, পাড়াপড়শি গর্ত পর্যন্ত পৌঁছতেই পারছেন না।
এরই মধ্যে কয়েক জনের মাথায় আসে, মাটির নীচে যখন আগুন দাপাচ্ছে, যে কোনও মুহূর্তে আরও কিছু ঘরের মেঝে-উঠোন ধসে যেতে পারে। বস্তির বাসিন্দা মহম্মদ সাজ্জাদ বলেন, “আসতেই আমরা সবাইকে ঘর থেকে টেনে বের করতে শুরু করি। ওই বাড়ি আর তার আশপাশের ১০টি পরিবারের রাতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে কাছেই একটি ক্লাবে।” হেনার বাবা-মা আপাতত সেখানেই। যদিও ক্লাবের মেঝেও যে রাতে ধসে যাবে না, তা কেউ বলতে পারে না।
খবর পেয়ে ইসিএলের খনি দুর্ঘটনায় উদ্ধারকারী দল রাত ৯টা ঘটনাস্থলে পৌঁছয়। গ্যাস-নিরোধক মুখোশ পরে, পিঠে অক্সিজেন নিয়েও কিন্তু তারা গর্তের কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। মেপে দেখা যায়, গর্তের মুখের কাছাকাছি তাপমাত্রা অন্তত ৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মিনিট দশেক চেষ্টার পরে হাল ছেড়ে জায়গাটি দড়ি দিয়ে ঘিরে তারা ফিরে যায়। ইসিএলের সিকিওরিটি ইনচার্জ লেফটেন্যান্ট কমান্ডান্ট দীপক প্রসাদ জানান, চেষ্টা করেও মেয়েটিকে উদ্ধার করা যায়নি।
ইসিএলের কর্মীরা ফিরে গেলেও মাটির নীচে আগুন থেমে নেই। এলাকার মানুষ আতঙ্কে চোখের পাতা এক করতে পারছেন না। দুর্ঘটনার খবর পেয়েই অনেকে কলোনি ছেড়ে বেরিয়ে যান। কয়েকটি পরিবারকে রাতেই আসানসোল কিংবা আশপাশে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে চলে যেতেও দেখা যায়। আগেই কলোনির আবাসন ছেড়ে অনেকে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। যাঁরা এখনও আছেন, তাঁদের অনেকে এখন পাকাপাকি এলাকা ছাড়ার কথা ভাবছেন। এঁদেরই এক জন তারকনাথ দাস বলেন, “অনেক দিন ধরেই কলোনি ছেড়ে যাব ভাবছি। আর ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না।” ইসিএল কর্মী স্বপন রায়ও বলেন, “আর নয়, এ বার অন্যত্র বদলি নিয়ে চলে যাব।”
হয় অবৈধ খনির দৌরাত্ম্য অথবা কয়লা তোলার পরে বৈধ খনি ঠিক মতো না বোজানোয় এর আগেও আসানসোল-রানিগঞ্জ কয়লাঞ্চলে বহু জায়গায় ধস নেমেছে। বছর কয়েক আগে জামুড়িয়ার পরাশকোলে মাটি ধসে ঢুকে গিয়েছিলেন দুই বাবা আর তাঁদের দুই ছেলেমেয়ে। রানিগঞ্জের নিমচা, সালানপুরের সংগ্রামগড় ও মোহনপুরেও বড় ধস নামে। ১২ নম্বর বস্তির উল্টো দিকে সাঁকতোড়িয়া গ্রামে শেষ বার ধস নেমেছিল ২০১০ সালে। কিছু বাড়ির ক্ষতি হলেও সে বার কারও প্রাণ যায়নি। সে বার গড়ে ওঠা ‘সাঁকতোড়িয়া গ্রামরক্ষা কমিটি’র সহ-সম্পাদক বাচ্চু মুখোপাধ্যায়ের অভিযোগ বলেন, “১৯৯৩-এ প্রথম বার ধস নামে। সেই থেকে এখনও যেখানে-সেখানে মাটির তলা থেকে গলগল করে ধোঁয়া বেরোয়। ইসিএল মাঝে-মধ্যে খনিগর্ভে বালি ভরাট করলেও দীর্ঘমেয়াদি ফল মিলছে না।”
ইসিএলের সিএমডি-র কারিগরি সচিব নীলাদ্রি রায় বলেন, “২০০৩ সালে ওই এলাকাকে ধসপ্রবণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। পুনর্বাসনের দায়িত্ব আসানসোল-দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদের (এডিডিএ)। তাদের ইতিমধ্যে ১৫৪ কোটি টাকাও দিয়েছে ইসিএল। ওখান থেকে বাসিন্দাদের সরানো না গেলে মাঝে-মধ্যেই মৃত্যু ঘটবে।” এডিডিএ-র চেয়ারম্যান নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ইতিমধ্যেই আমরা এলাকার জনবিন্যাসের সমীক্ষা ইসিএলের সঙ্গে কথা বলছি। দেখি, কী করা যায়।”
|
পুরনো খবর: সাঁকতোড়িয়ায় ফের ধস, মাটি ফুঁড়ে উঠল আগুনও |
|
|
|
|
|