সিপিএম এবং বামফ্রন্টের অন্দরে যা অনেকের মনের কথা, তা-ই এ বার সামনে এনে দিলেন দলের প্রাক্তন নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। কোনও খেলায় দল বারবার হারলে যেমন কোচ বা অধিনায়ক বদলানো হয়, বাম নেতৃত্বেরও সেই রেওয়াজ অনুসরণ করা উচিত বলে সওয়াল করলেন সোমনাথবাবু। কোচের মতো বাজারে নেতা পাওয়া যায় না বলে তাঁর পরামর্শ অবশ্য সবিনয় ফিরিয়ে দিয়েছে সিপিএম। তবে প্রবীণ প্রাক্তন নেতার এমন পরামর্শ বাম শিবিরে ফের তীব্র বিতর্ক উস্কে দিয়েছে।
পঞ্চায়েতের পরে ১২টি পুরসভার ভোটেও বামেদের বিপর্যয় নিয়ে প্রশ্ন ছিল লোকসভার প্রাক্তন স্পিকারের কাছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর এক অনুষ্ঠানের অবসরে তৃণমূলের সাফল্য প্রসঙ্গে সোমনাথবাবু অবশ্য বলেন, “এটা জয় নয়। তাণ্ডব করে, জোরজবরদস্তি করে জয় করা হচ্ছে! এটাকে জয় বলা যায় না।” কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর অভিমত: গদি নয়, সাধারণ মানুষের স্বার্থে যে বামপন্থী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, তা দুর্বল হয়েছে। বাম নেতৃত্ব বিষয়টি পর্যালোচনা করবেন বলে সোমনাথবাবুর আশা। |
তা হলে কি বামেদের সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের জন্য নেতৃত্বই দায়ী? সোমনাথবাবুর মন্তব্য, “এক জন নেতা, ক্যাপ্টেন বা জেনারেলের উপরে সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে। যেমন টিম বারবার হারলে কোচ বদল হয়, বা ক্যাপ্টেনকে তাড়ায়, সেই রকমই!” সিপিএম বা বামফ্রন্টের কোন নেতৃত্বের পরিবর্তন হওয়া উচিত, তা নির্দিষ্ট করে সোমনাথবাবু বলেননি ঠিকই। সিপিএমেরই একাংশের ধারণা, লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার আসলে বোঝাতে চেয়েছেন প্রকাশ কারাট থেকে শুরু করে দলের সর্ব স্তরের নেতৃত্বকে। বিশেষত, তাঁর বহিষ্কারকে কেন্দ্র করে কারাটের সঙ্গে সোমনাথবাবুর যা সমীকরণ, তাতে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদকের দিকে ইঙ্গিতই প্রত্যাশিত। তা ছাড়া, দলে না-থাকলেও প্রয়াত জ্যোতি বসুর অন্যতম শিষ্য সোমনাথবাবুর সঙ্গে বেশ কিছু দিন ধরেই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু, গৌতম দেব-সহ আলিমুদ্দিনের সম্পর্ক ভাল। সেই বিচারেও তিনি বিমানবাবুদের অপসারণ চাইবেন না বলেই দলের একাংশের ব্যাখ্যা।
তবে সিপিএমেরই অন্য একাংশ আবার মনে করছে, ১২টি পুরসভার ভোট-সহ রাজ্যে সাম্প্রতিক নির্বাচনী বিপর্যয় প্রসঙ্গে যে হেতু এমন মন্তব্য, তাই বহিষ্কৃত নেতার ইঙ্গিত আলিমুদ্দিনের দিকেই। নেতৃত্ব বদল নিয়ে সিপিএমে সাম্প্রতিক কালে যা হইচই, সবই রাজ্য কমিটির অন্দরে। এমতাবস্থায় সোমনাথবাবু আলাদা করে কারাটকে নিশানা করবেন, এমনটা ধরে নেওয়া বাস্তবসম্মত নয় বলেই ওই অংশের মত।
ইঙ্গিত যে দিকেই হোক, সোমনাথবাবুর মুখে নেতৃত্ব বদলের পরামর্শ স্বভাবতই অন্য রকম আলোড়ন তৈরি করেছে সিপিএমের অন্দরে। প্রস্তাবকের নাম সোমনাথবাবু বলেই খুব কৌশলে তাঁর মতের জবাব দিতে হয়েছে আলিমুদ্দিনকে। কূটনৈতিক মোকাবিলার পথে হেঁটেছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও। পলিটব্যুরোর এক সদস্যের কথায়, “প্রকাশ কারাট বা বিমান বসু, এই ভাবে বিষয়টিকে দেখা ঠিক হবে না। কমিউনিস্ট পার্টি কোনও ব্যক্তি নয়, যৌথ নেতৃত্বের উপরে চলে। উনি নেতৃত্বে রদবদলের একটা প্রক্রিয়া শুরু করার কথা বলেছেন বলেই মনে হয়।” আলিমুদ্দিনের তরফে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্যামল চক্রবর্তীরও একই সুর, “আমাদের দলে যৌথ সিদ্ধান্ত হয়। কোনও সিদ্ধান্ত সফল হলেও তা যেমন যৌথ, ব্যর্থতা হলে তার দায়ও যৌথ ভাবে সকলের।”
ধর্মতলায় এ দিনই কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির জমায়েত ও মিছিলের অবসরে সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামলবাবু বলেছেন, “সোমনাথদা বামপন্থী রাজনীতি ও আন্দোলনকে ভালবাসেন। কিন্তু তাঁর এই পরামর্শ নিতে পারছি না!” কেন? শ্যামলবাবুর ব্যাখ্যা, “কোচ বাজারে পাওয়া যায়। দরকার হলে কাউকে সরিয়ে কোচ ভাড়া করে আনা যায়। কিন্তু রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব বাজারে মেলে না!” কমিউনিস্ট পার্টিতে প্রবীণ ও অভিজ্ঞ, মাঝারি ধরনের অভিজ্ঞ এবং তুলনায় নবীন তিন ধরনের মুখের সমন্বয়েই নেতৃত্ব তৈরি হয় বলে তাঁর যুক্তি।
এই পরিস্থিতিতে সোমনাথবাবুর মতো পরামর্শদাতার কাছ থেকে কোচিং টিপস নেওয়া যেতে পারে কি? শ্যামলবাবুর জবাব, “ওঁর অনেক পরামর্শই আমরা নিই। এটা নিতে পারছি না! তা ছাড়া, সাময়িক বিপর্যয়ে এমন কথা অনেক সময়ই আসে। আগে ১৯৭২-৭৭ সালে আক্রমণের মুখে জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্তের পদত্যাগের দাবিও উঠেছিল।” শ্যামলবাবু বোঝাতে চেয়েছেন, সাতের দশকে আক্রমণের মোকাবিলা করে বামেরা যে ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিল, এ বারও তা-ই পারবে। সিপিএমেরই আর এক প্রাক্তন নেতা সমীর পূততুণ্ডের মতে, “বামপন্থার কিছু প্রয়োগ কৌশলে ভুল এবং সাংগঠনিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার জন্য সঙ্কট তৈরি হয়েছে। কিন্তু এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই যে, কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক পাল্টে দিলেই সমস্যা মিটে যাবে!”
|