সন্ত্রাসের খাসতালুকে শান্তির বার্তা মমতার
দু’বছর আগে মহাকরণে বসেই তাঁর চ্যালেঞ্জ ছিল, অশান্ত জঙ্গলমহলে তিনি হাসি ফোটাবেন, শান্তি ফেরাবেন। গত চার দিন ধরে মাওবাদীদের একদা খাসতালুক চষে ফেলে বুধবার সন্ধ্যায় তৃপ্ত মুখ্যমন্ত্রী বললেন, “আমি পেরেছি।”
শুরু হয়েছিল পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়-বাঘমুণ্ডি থেকে। বাঁকুড়ার খাতরা, বারিকুল এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের শিলদা হয়ে এই পরিক্রমা শেষ হল ঝাড়গ্রামে। দীর্ঘ যাত্রার সবটাই গাড়িতে।
যে পথে মমতা যান, সে পথে জনতা দাঁড়ায়। এটা হয়তো খুব অচেনা দৃশ্য নয়, তবে এ বারের কথা স্বতন্ত্র। কারণ, এ বার তিনি ভেদ করেছেন দু’ধারের গভীর অরণ্য অঞ্চল। আগে মাওবাদী-আতঙ্কে এলাকা সিঁটিয়ে থাকত। দোকানপাট ঝাঁপ ফেলত দিনের আলো ফুরনোর আগেই।
মমতার চলার পথের দু’পাশে এ বার যাঁরা ভিড় করেছেন, তাঁদের একটি বড় অংশ জঙ্গলমহলের সংসারী সাদামাটা ভূমিপুত্র। পুরুষ-মহিলা-শিশু-বৃদ্ধ সবাই এসেছেন মুখ্যমন্ত্রীকে এক ঝলক দেখতে। বার বার গাড়ি থামাতে থামাতে দু’ঘণ্টার পথ পেরোতে মুখ্যমন্ত্রীর লেগেছে প্রায় দ্বিগুণ সময়। কিন্তু কারওকেই নিরাশ করেননি তিনি। তাঁদের কথা শুনেছেন। যেখানে এক জন দাঁড়িয়ে সেখানেও স্তিমিত হয়েছে তাঁর গাড়ির গতি। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, “আমি ওঁদের জন্য এখানে এসেছি। তাই ওঁদের যত জনের কাছে পারি পৌঁছনোটা দরকার বলে মনে করি।”
কেমন আছেন আপনারা? জানতে হঠাৎ গাড়ি থেকে নেমে এক বাড়িতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
বুধবার সন্ধ্যায় শিলদা থেকে ঝাড়গ্রামের পথে আচমকা গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী। সবাই হতভম্ব। কোথায় যাচ্ছেন? গ্রামের নাম গোপীনাথপুর। পথের পাশে সতীনাথ পাথরের মাটির বাড়ি। মুখ্যমন্ত্রী সটান ঢুকে পড়েন সেখানে। ডেকে আনেন বাড়ির বৌ-ঝিদের। ঘরের দাওয়ায় মুখ্যমন্ত্রীকে দেখে তাঁরা তো হতবাক। তাঁর জন্য পেতে দেওয়া হয় প্লাস্টিকের চেয়ার। দাওয়ায় বসে গল্প জুড়ে দেন তিনি। বলেন, “আমাকে একটু চা খাওয়াবেন? চা-পাতা আছে? না-থাকলে একটু মুড়ি দিন। আমি কিন্তু না-খেয়ে যাব না।” বাড়ির ভিতর থেকে তাড়াতাড়ি এনে দেওয়া হল এক গ্লাস দুধ। মুখ্যমন্ত্রী হাসতে হাসতে বললেন, “না না, আমি দুধ খাই না।” কথা বলতে বলতেই খুঁটিয়ে জেনে নিলেন প্রাপ্য সরকারি সাহায্য তাঁরা ঠিকমতো পাচ্ছেন কি না। প্রয়োজনীয় নির্দেশও দিলেন জেলাশাসককে।
বস্তুত গোটা যাত্রাপথেই পথের ধারে দাঁড়ানো মানুষজন বার বার অনুরোধ বা আবেদনপত্র তুলে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর হাতে। চলতে চলতেই তা পড়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা অফিসারদের ফোন করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এ ভাবেই পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-পশ্চিম মেদিনীপুরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের সমস্যা অবিলম্বে মেটাতে বলেছেন, নির্দেশ দিয়েছেন সেতু বা সড়কের দ্রুত মেরামতির। এমনকী, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে চাকরি বা আর্থিক অনুদানের বন্দোবস্ত করে দিতেও বলেছেন।
গত পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলকে বিপুল ভাবে সমর্থন করেছেন জঙ্গলমহলের মানুষ। এ বার তৃণমূলনেত্রীকে ঘরের মাটিতে স্বাগত জানাতে জঙ্গলমহল তাই কতকটা যেন তৈরিই ছিল। রাস্তায় ঝোলানো হোর্ডিংয়ে লেখা ‘বুভুক্ষু অত্যাচারিতদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অভিনন্দন’। ঠিক এই বিষয়টিই প্রতিটি সভায় নিজের মতো ব্যাখ্যা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, ক্ষোভ তো ছিল বঞ্চনার বিরুদ্ধে। তাকে উস্কে দিয়ে সন্ত্রাস কায়েম করেছিল মাওবাদীরা। এখন সরকার দাঁড়িয়েছে মানুষের পাশে। তাঁদের চাহিদা পূরণে দু’হাত ভরে দিচ্ছে, দেবে। জঙ্গলমহলের মানুষকেও তাই বলতে হবে, বন্দুক নয়, শান্তি চাই। বিচ্ছিন্ন করতে হবে সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীদের।
বাঘমুণ্ডি-বারিকুল-শিলদার মতো মাওবাদী ‘মুক্তাঞ্চল’-এ বিপুল জনস্রোত দেখে মুখ্যমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন, “জনতার শক্তি আমাদের সঙ্গে। সন্ত্রাসবাদীদের সাধ্য নেই এর মোকাবিলা করার।” আর সভায় দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ করেছেন, “কারও রাজনৈতিক বিশ্বাসে ঘা দিতে চাই না। কিন্তু যারা চোরাগোপ্তা সন্ত্রাস চালায় তাদের বলছি, তারা কাপুরুষের দল। সাহস থাকলে সামনে এসে দাঁড়াক।”
মহাকরণের কর্তাদের কাছে খবর আছে যে, লাগোয়া ঝাড়খণ্ড থেকে মাওবাদীরা মাঝেমধ্যেই লুকিয়ে-চুরিয়ে ঢুকে পড়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। যেমন হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর অযোধ্যা পাহাড়ে যাওয়ার দিন তিনেক আগে। সেখানে ঢুকে পড়েছিল মাওবাদীদের চারটি স্কোয়াড। প্রশাসন অবশ্য কোনও ঝুঁকি নিতে চায়নি। মুখ্যমন্ত্রীর যাওয়ার রাস্তায় ঘন জঙ্গল জুড়ে ছিল অতন্দ্র প্রহরা। তাঁর এ বারের গন্তব্যগুলিও ছিল পুলিশের চোখে রীতিমতো স্পর্শকাতর। যেমন অযোধ্যা পাহাড়-বাঘমুণ্ডি। যেখানে অপহরণ করে খুন করা হয় কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মী পার্থ বিশ্বাস ও স্কুলশিক্ষক সৌম্যজিৎ বসুকে। বাঁকুড়ার বারিকুল, যেখানে বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যান ওসি প্রবাল সেনগুপ্ত। পশ্চিম মেদিনীপুরের শিলদা, যেখানে ইএফআর ক্যাম্পে মাওবাদীরা হামলায় নিহত হন ২৪ জন জওয়ান।
সরকারি সাহায্য বিতরণ এবং সভা করার জন্য এই তিনটি জায়গাকে বেছে নেওয়া এক অর্থে যেন মাও-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর কড়া জবাব। যেখানে যেখানে মাওবাদীদের নির্বিচার সন্ত্রাস হয়েছে, ঠিক সেই জায়গাগুলিতে জনগণকে পাশে পাওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন তিনি। আর সেই কাজে মুখ্যমন্ত্রী ষোলো আনা সফল বলেই দাবি শাসক দলের।

নিহত ওসি-র নামে স্কুল, জওয়ানদের স্মৃতিতে সৌধ
মাওবাদীদের দুই শক্ত ঘাঁটিতে দাঁড়িয়ে মাওবাদীদেরই হাতে নিহত পুলিশকর্মী ও জওয়ানদের স্মৃতিরক্ষার কথা ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার তিনি জানান, বাঁকুড়ার বারিকুলে নিহত ওসি প্রবাল সেনগুপ্তর স্মৃতিতে স্থানীয় স্কুলের নামকরণ হবে। আর পশ্চিম মেদিনীপুরের শিলদায় নিহত ইএফআর জওয়ানদের স্মৃতিতে তৈরি হবে সৌধ। জঙ্গলমহলের বহু মানুষই বলছেন, এমন ভাবনা এই প্রথম। এ বারের জঙ্গলমহল সফরের শেষ পর্বে বুধবার দুপুরে মমতার প্রথম প্রশাসনিক সভাটি হয় মাওবাদী প্রভাবিত বারিকুলের পূর্ণাপানির মাঠে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এখানে মাওবাদীদের হাতে খুন হয়েছিলেন ওসি প্রবাল সেনগুপ্ত। আরও অনেকে খুন হয়েছেন। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশে কিছু কাজ করতে পারলে ভাল। তাই সাতনালা ঊষা শিশু শিক্ষা নিকেতনের নামকরণ প্রবালবাবুর নামে করা হল।” ২০০৫-এর ৬ জুলাই রাতে বারিকুলে মাওবাদী হামলায় খুন হয়েছিলেন এক সিপিএম নেতা ও এক কর্মী। তদন্তে এসে মাওবাদীদের রেখে যাওয়া বিস্ফোরকে মৃত্যু হয় প্রবালবাবুর। শিলদায় ২০১০-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি ইএফআর ক্যাম্পে মাওবাদী হামলায় প্রাণ হারান ২৪ জন জওয়ান। ঘটনাস্থলের অদূরে শিলদা চন্দ্রশেখর কলেজ মাঠে দ্বিতীয় সভাটি করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, নিহতদের শ্রদ্ধা জানাতে স্মৃতিসৌধ বানাবে পুলিশ। সভা চলাকালীন তুমুল বৃষ্টি নামে। তারই মধ্যে হাজার সাতেক মানুষ ঠায় দাঁড়িয়ে মমতার বক্তব্য শোনেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “জঙ্গলমহলের মানুষের আমাদের প্রতি আস্থা রয়েছে বলেই বৃষ্টির মধ্যেও এত মানুষ এসেছেন।” দু’জায়গাতেই জঙ্গলমহল ‘মাওবাদী-শূন্য’ করার ডাক দেন মমতা। বলেন, “মাওবাদীরা খতম তালিকার প্রথমে আমার নাম রেখেছে। আমাকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। বারবার জঙ্গলমহলে আসব।”

পুরনো খবর:





First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.