গ্রাম বাংলায় দুর্গ প্রতিষ্ঠার পরে শহরেরও দখল নিল তৃণমূল কংগ্রেস।
মঙ্গলবার প্রকাশিত পুরভোটের ফলে পুরোদস্তুর শহর থেকে গ্রাম-ঘেরা পুর এলাকা সর্বত্রই তাদের দাপট। এক ডজন পুরসভার মধ্যে আটটি (২০০৮-এর চেয়ে পাঁচটি বেশি) দখল করে তৃণমূল বুঝিয়ে দিল, পঞ্চায়েত ভোটে যেমন ভাবে প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দাদের সমর্থন পেয়েছিল, তেমন ভাবেই পাশে পেয়েছে শহুরে মধ্যবিত্তকে। আসন্ন লোকসভা ভোটের নিরিখে যে ফল তৃপ্তি দেবে তৃণমূল নেতাদের।
পক্ষান্তরে, গত বার পাঁচটি পুরসভা দখলে রাখা বামেদের এ বার প্রাপ্তি বলতে শুধু মেখলিগঞ্জ। যে দুই পুরসভা থেকে তারা প্রার্থী প্রত্যাহার করেছিল, সেই বর্ধমানে ৩৫-০ এবং চাকদহে ২১-০ ফলে জিতেছে তৃণমূল। এই ফল তুলে ধরে ভোট বয়কটের সিদ্ধান্ত যথাযথ বলেই দাবি করছেন সিপিএম নেতারা। যদিও সেই সিদ্ধান্ত ঘিরে দলে বিতর্ক শুরু হয়েছে। প্রশ্ন তুলেছে পলিটব্যুরোও।
অন্য দিকে, কংগ্রেস গত বার একার শক্তিতে ক্ষমতায় থাকা দু’টি পুরসভা ডালখোলা এবং হলদিবাড়ি দখলে রেখেছে। বাকি যে দু’টি পুরসভায় তারা তৃণমূলের সমর্থন নিয়ে বোর্ড গড়েছিল, তার মধ্যে আলিপুরদুয়ার এ বারও ত্রিশঙ্কু। ২০ আসনের পুরসভায় কংগ্রেস এবং তৃণমূল ৬টি করে আসন পেয়েছে। দুবরাজপুর অবশ্য কংগ্রেসকে পিছনে ফেলে তৃণমূল একার শক্তিতেই দখল করে নিয়েছে।
মঙ্গলবার ভোটের ফল জেনে পুরুলিয়ায় তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এই জয় মানুষের জয়। ভালোবাসার জয়। মানুষ আস্থা রেখেছেন। কৃতিত্ব মানুষের। এই ফল আমাদের অনুপ্রেরণা জোগাবে। ২৫ নভেম্বর কলকাতার ব্রিগেডে এই জয় মানুষকে উৎসর্গ করব।” তাঁর সংযোজন, “কংগ্রেস, সিপিএম, ফরওয়ার্ড ব্লক, বিজেপি এক সঙ্গে লড়ে ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছে. আমরা একাই পেয়েছি ৭০ শতাংশ।” পঞ্চায়েতের পরে এ বার পুর-এলাকার মানুষের সমর্থন পাওয়া নিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া, “গ্রাম, শহর সব মানুষই এক। মানুষ আমাদের উপরে বিশ্বাস রেখেছেন।” |

পানিহাটি ৪ নম্বর ওয়ার্ডে জয়ী তৃণমূল প্রার্থী
বিউটি অধিকারী (চট্টোপাধ্যায়)।
মঙ্গলবার। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়। |
তৃণমূল নেতৃত্ব এমন দাবি করতেই পারেন। কারণ, ২০০৮-এ তাঁরা যে তিনটি পুরসভায় ক্ষমতায় ছিলেন, সেই হাবরা, ডায়মন্ড হারবার এবং গুসকরার তখ্ত এ বারেও অক্ষত, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিয়ে বিস্তর বাজার গরম হলেও। তার উপরে এ বার তৃণমূলের ঝুলিতে এসেছে বর্ধমান, চাকদহ, পানিহাটি, বালুরঘাট (সবই বামেদের ছিল) এবং দুবরাজপুর পুরসভা (গত বার ছিল কংগ্রেসের)। তার মধ্যে ডায়মন্ড হারবারে এ বার তৃণমূলের জয়ের হ্যাটট্রিক হয়েছে। তবে দখলে থাকা পুরসভাগুলির মধ্যে একমাত্র ডায়মন্ড হারবারেই তৃণমূল গত বারের তুলনায় একটি আসন কম পেয়েছে। সিপিএমের আসন বেড়েছে দু’টি।
রাজ্যে পালাবদলের আগে পানিহাটি পুরসভা কখনও হাতছাড়া হয়নি বামেদের। শনিবার ভোট চলাকালীন একাধিক জায়গায় গোলমালের খবর মিললেও পানিহাটির ক্ষেত্রে সিপিএম ভোট বয়কটের রাস্তায় হাঁটেনি। রাজ্যের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পান্ডে নজিরবিহীন ভাবে সেখানে গিয়েছিলেন। চারটি বুথে পুনর্নির্বাচনও হয়। কিন্তু এ বার ৩৫ আসনের ওই পুরসভায় তৃণমূল যেখানে একাই ৩০টি আসন পেয়েছে, সিপিএম সেখানে ২ (গত বার বামেদের ছিল ২২টি), ৩টি কংগ্রেসের।
এমন হল কেন? আপাদমস্তক শহুরে মানসিকতার পানিহাটির মানুষ কি বাম-ঐতিহ্যে আস্থা হারালেন? সিপিএম নেতা তথা প্রাক্তন পুরপ্রধান চারণ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে।”
বামেদের পর্যালোচনার আর একটি বিষয় হতে পারে তাঁদের প্রার্থীদের হারের ব্যবধান বাড়া, তা-ও আবার বর্ধমানের মতো একদা লাল-দুর্গে। দু’বছর আগে বিধানসভা নির্বাচনে বর্ধমান শহরে সব ওয়ার্ডে হেরেছিলেন প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন। এ বার সে ফল অপরিবর্তিত। শুধু ৩৫টি ওয়ার্ডে বাম প্রার্থীদের হারের ব্যবধান ৩৭ হাজার থেকে বেড়ে লাখ ছাড়িয়েছে। সিপিএমের জেলা সম্পাদক অমল হালদার বলছেন, “প্রার্থী প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত যে ১১০ ভাগ ঠিক ছিল, তা এই ফলেই প্রমাণিত হয়েছে।”
কী ভাবে? অমলবাবুর ব্যাখ্যা, “যদি চোখের সামনে রিগিং দেখেও নীরবে সব সহ্য করতাম, তা হলে আজকের এই ফলে দলের কমরেডদের আত্মবিশ্বাস চুরচুর হয়ে যেত। তাঁরা তখন আমাদের বলতেন, কেন আপনারা সরে এলেন না ভোট থেকে?” চাকদহ পুরসভায় দীর্ঘ দিন পরে ক্ষমতা হারিয়ে সিপিএমের নদিয়া জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমল ভৌমিকও হারের জন্য শাসক দলের বিরুদ্ধে রিগিং-এর অভিযোগই তুলেছেন। খোদ বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুর মন্তব্য, “এই রকম অগণতান্ত্রিক পরিবেশে পুরভোট হওয়ায় ভোটের ফলাফলে জনগণের মতামতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটেছে বলা যায় না।”
তবে শাসক দলের নেতারা এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তৃণমূলের নেতা মুকুল রায় বলেছেন, “পঞ্চায়েত ভোটে গ্রামবাংলার জনতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্যে যে উন্নয়ন-কর্মসূচি চলছে, তাকে সমর্থন করেছিলেন। পুর-ভোটে জয়ের ধারা অব্যাহত রেখে শহরাঞ্চলের মানুষও মমতাদির উন্নয়ন-কর্মসূচিকে সমর্থন জানিয়েছেন।” |
পুরসভা ১২ |
তৃণমূল ৮

গুসকরা | ডায়মন্ড হারবার | হাবরা | বর্ধমান |
পানিহাটি | দুবরাজপুর | চাকদহ | বালুরঘাট
২০০৮ | ৩
গুসকরা | ডায়মন্ড হারবার | হাবরা |
বামফ্রন্ট ১

মেখলিগঞ্জ
২০০৮ | ৫
পানিহাটি | বর্ধমান | চাকদহ |
বালুরঘাট | মেখলিগঞ্জ |
কংগ্রেস ২

ডালখোলা | হলদিবাড়ি
২০০৮ ৪
হলদিবাড়ি | ডালখোলা
জোট
দুবরাজপুর | আলিপুরদুয়ার |
ত্রিশঙ্কু ১
আলিপুরদুয়ার |
|
“গ্রাম, শহর সব মানুষই এক। মানুষ আমাদের উপরে বিশ্বাস রেখেছেন।”
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
|
পঞ্চায়েত ভোটের জন্য ২১ জুলাইয়ের শহিদ দিবসের অনুষ্ঠান পিছিয়ে ২৫ নভেম্বর ব্রিগেডে করার কথা আগেই তিনি ঘোষণা করেছিলেন। পঞ্চায়েত ভোটে বিপুল সাফল্যের পর বিজয় সমাবেশ ব্রিগেডের ওই সভায় হবে বলে জানিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বার ১২টি পুরসভার মধ্যে আটটিতে জয়ের উদ্যাপনও সেখানেই হবে বলে মঙ্গলবার পুরুলিয়ায় ঘোষণা করেন তিনি। লোকসভা ভোটের আগে ব্রিগেডের ওই সমাবেশ দলের কাছেও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে তৃণমূল নেতাদের একাংশের ধারণা। |