ভোট হয়েছে ১২টি পুরসভায়। পাঁচ বছর আগে যার মধ্যে পাঁচটিতে জিতেছিল বামফ্রন্ট (এ বারে ঝুলিতে মাত্র একটি)। কিন্তু মঙ্গলবার ফল বেরনোর পরে আলোচনায় রইল মূলত একটি পুরসভা: বর্ধমান। সন্ত্রাসের অভিযোগে নির্বাচনের দিন মাঝপথে ভোট বয়কটের ফল কী হতে পারে, তা অনুমান করতে পারছিলেন সকলেই। হলও তাই। এবং ময়দান ছেড়ে পালানো নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে সিপিএমের অন্দরে, এই ফল সেটাকেই আরও বেশি করে উস্কে দিল।
দু’বছর আগে বিধানসভা নির্বাচনে বর্ধমান শহরে সব ওয়ার্ডে হেরেছিলেন প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন। এ বারও ফল সেই ৩৫-০। তফাত শুধু হারের ব্যবধান। দু’বছর আগে নিরুপমবাবু হেরেছিলেন ৩৭ হাজার ভোটে। এ বারে ৩৫টি ওয়ার্ডের সব ক’টির ব্যবধান মেলালে তা লাখ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সন্ত্রাসের অভিযোগে চাকদহেও ভোট বয়কট করেছিল বামফ্রন্ট। এবং সেখানেও তারা নিশ্চিহ্ন। ফল ২১-০।
এই ভাবে বয়কটের ফলে দলের কী লাভ হল সিপিএমের অন্দরে সেই প্রশ্নই ক্রমশ জোরালো হচ্ছে।
সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতাদের একটা বড় অংশই মনে করছেন, এই ভাবে পিছিয়ে আসায় নেতিবাচক বার্তা যাবে। গোটা রাজ্যেই দলীয় কর্মীদের মনোবল ধাক্কা খেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে দলের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়ায় ভাটা পড়তে পারে। রাজ্যের অন্য জেলার নেতারাও অনেকে বলছেন, এর ফলে প্রকাশ্যে স্বীকার করে নেওয়া হল যে, দলের সাংগঠনিক শক্তি নেই। তাতে হার তো হলই, ক্ষতি হল ভাবমূর্তিরও। তাঁদের আশঙ্কা, তৃণমূল এতে আরও ‘রক্তের স্বাদ’ পেয়ে যাবে। তার থেকে লড়ে গেলে যা পাওয়া যেত, সেটুকুই লাভ হত।
সিপিএমের অন্দরে দুই ২৪ পরগনার নেতৃত্বের সঙ্গে বর্ধমানের টানাপোড়েন অনেক দিনের। উত্তর ২৪ পরগনার হাবরা বা পানিহাটিতে খারাপ ফল হলেও সিপিএম কিছু আসন জিতেছে। আসন বাড়িয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবারে। সে ক্ষেত্রে, বর্ধমান জেলা নেতৃত্ব ভোট চলাকালীন প্রার্থী প্রত্যাহারের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা কি সঠিক ছিল? সরাসরি জবাব এড়িয়ে দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক গৌতম দেব বলেন, “সন্ত্রাসের মুখে দাঁড়িয়েও আমাদের জেলায় কমরেডরা লড়াইয়ের চেষ্টা করেছেন। বর্ধমান জেলা নেতৃত্ব পরিস্থিতি বিচার করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।” বর্ধমানের ভূমিপুত্র, পলিটব্যুরো সদস্য নিরুপম সেন অবশ্য দাবি করেন, পানিহাটি, হাবরা বা চাকদহে সন্ত্রাস হলেও তা বর্ধমানের মতো হয়নি।
কেমন সন্ত্রাস হয়েছিল বর্ধমানে? নিরুপমবাবুর দাবি, “ওরা (তৃণমূল) বলেই দিয়েছিল, যেন তেন প্রকারে বর্ধমান পুরসভা দখল করবে। সাতাত্তর বছরের বৃদ্ধাকে রিভলভার দেখিয়ে বের করে দিয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায়, আমরা বাধা দিতে গেলে কী ঘটত!” নিরুপমবাবুর যুক্তি, “অনেকে মনে করছেন, দু’তিনটে লাশ পড়ার পরে প্রার্থী প্রত্যাহার করা হলে, সেই সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত বলে প্রমাণ হত। কিন্তু তাতে আমাদের রাজনৈতিক লাভ হত না। বরং তাতে মানুষ আরও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ত।” সন্ত্রাসের পুরো ছবি সংবাদমাধ্যমে উঠে আসেনি বলেও তিনি দাবি করেন। কিন্তু দিল্লির এ কে গোপালন ভবনের অনেকেই যে মনে করছেন, এ ভাবে পালিয়ে আসাটা ঠিক হয়নি? বর্ধমান জেলা সম্পাদক অমল হালদার বলেন, “পলিটব্যুরোর ব্যাপার-স্যাপার আমি বলতে পারবো না। ওঁদের কেউ হয়তো আপনাদের কানে-কানে বলেছেন, আমাদের সরে আসাটা ঠিক হয়নি। তবে এটা বামফ্রন্টের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত।”
এ দিন ভোটের ফল নিয়ে আলিমুদ্দিন কোনও সাংবাদিক বৈঠক করেনি। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু এক বিবৃতিতে বর্ধমান জেলা নেতৃত্বের পাশেই দাঁড়িয়েছেন। যেমন দাঁড়িয়েছেন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেব। রবীনবাবু বলেন, “রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জেলা নেতৃত্ব। তাঁদের সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল ভোটের ফলেই তা প্রমাণিত।” পানিহাটি, হাবরা বা ডায়মন্ড হারবারে কী করে কিছু ওয়ার্ড জিতল বামেরা? রবীনবাবুর ব্যাখ্যা, “ওই সব জায়গায় সন্ত্রাস হলেও কিছু এলাকায় মানুষ ভোট দিতে পেরেছেন।” বিমানবাবুও দাবি করেন, ভোটের দিন যে ভাবে তৃণমূল বিভিন্ন পুর এলাকায় সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে, তাতে ভোটের ফলাফলে জনগণের মতামতের প্রকৃত প্রতিফলন হয়নি।
বস্তুত, নিরুপম-সহ রাজ্য নেতৃত্বের একাংশ দাবি করছেন, প্রধান বিরোধী দল হিসেবে ভোটের মাঝপথে তাঁরা সরে দাঁড়ানোয় তৃণমূলের এই জয়ের আর কোনও যৌক্তিকতা রইল না। প্রার্থী প্রত্যাহার করে সেই বার্তাটাই দিতে চেয়েছিলেন তাঁরা। অমলবাবুর আরও যুক্তি, “যদি চোখের সামনে রিগিং দেখেও আমরা সরে না আসতাম, তা হলে আজকের এই ফলে দলের কমরেডদের আত্মবিশ্বাস চুরচুর হয়ে যেত। তাঁরা তখন আমাদের বলতেন, কেন আপনারা নীরবে সহ্য করলেন সব কিছু? কেন সরে এলেন না ভোট থেকে?”
যদিও স্থানীয় মানুষের অনেকেরই বক্তব্য, বর্ধমান বা চাকদহের বুথে-বুথে মোটেই তেমন সন্ত্রাসের চেহারা চোখে পড়েনি। রক্তপাত, খুন-জখম, ভোটার হটিয়ে বুথ দখলের ঘটনা ঘটেনি। বরং সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে যে সব ওয়ার্ডে ব্যাপক রিগিংয়ের অভিযোগ তুলেছিল সিপিএম, তারই কোনও কোনওটিতে ১৯, ২০, ২৪, এমনকী ৩১ শতাংশ ভোটও পেয়েছেন বামপ্রার্থীরা। পানিহাটি এবং হাবরাতেই বরং বেশি গণ্ডগোল হয়েছে।
এ কে গোপালন ভবনের অনেকেই, বিশেষ করে কেরলের নেতারা কিন্তু প্রশ্ন তুলছেন, যত দিন তৃণমূল ক্ষমতায় থাকবে, তত দিন যদি এই সন্ত্রাস চলে, সিপিএম কি খালি ভোটের ময়দান থেকে পালিয়েই বেড়াবে? বর্ধমানের নেতারা যেখানে সাংগঠনিক শক্তি না থাকার যুক্তি দিচ্ছেন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনেকেরই বক্তব্য, রাজনৈতিক মোকাবিলার মধ্যে দিয়েই সাংগঠনিক শক্তি বাড়ে। ভোট থেকে সরে নয়। নিরুপমবাবুরা অবশ্য বলছেন, বিধানসভা ভোটে বিপর্যয়ের আড়াই বছরের মধ্যেই সিপিএম সব ভোটে জিততে শুরু করবে, এমন আশা অনুচিত। প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রীর কথায়, “এতটা গগনচুম্বী প্রত্যাশা কারও ছিলও না।” পরোক্ষে কেন্দ্রীয় নেতাদের সংশয়ের জবাব দিয়ে তিনি জানান, কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন লোকসভা ভোট পরিচালনা করবে, ফলে সেখানে তৃণমূলের পক্ষে এই ধরনের সন্ত্রাস চালানো সম্ভব হবে না। নিরুপম বলেন, “বিধানসভা নির্বাচনের পরেও তো জঙ্গিপুরে ভোট হয়েছে। চারটি বিধানসভা, হাওড়া লোকসভার উপ-নির্বাচন হয়েছে। কিছু তো বলিনি!”
আলিমুদ্দিনের জন্য বর্ধমান জেলা নেতৃত্ব যে রিপোর্ট তৈরি করছেন, তাতে এই রিগিং ও সন্ত্রাসের বিবরণই দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ভোটের আগে তিন দিন ধরে বাড়ি-বাড়ি হুমকি দেওয়া হয়েছে। ভোটের দিন সকালেই পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়। যাঁরা ভোটের লাইনে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে কারা কারা সিপিএমের সমর্থক, তা চিহ্নিত করে বের করে দেওয়া হয়। সকাল ৯টার মধ্যে কোনও ভোটকেন্দ্রের ত্রিসীমানায় সিপিএমের কোনও লোক ছিল না। গোটাটাই দাপিয়ে বেড়িয়েছে তৃণমূল বাহিনী। যাঁরা ভোট দিতে গিয়েছেন, তাঁদের জোড়াফুল চিহ্নে ভোট দিতে বাধ্য করা হয়। কথা না শুনলে মারধর করা হয়েছে। ফলে বাকিরাও ভয়ে আর বুথমুখো হননি। |