মার্সিডিজ ট্যাক্সিতে উঠে চালকের পিছনের আসনে বসেছিলেন তিনি। কলকাতা থেকে একটি কর্পোরেটের উচ্চপদস্থ কর্তা অফিসের কাজে গিয়েছিলেন সিঙ্গাপুরে। ট্যাক্সিচালক বললেন, “দয়া করে আগে সিটবেল্ট বেঁধে নিন।” কর্পোরেট-কর্তা তা শুনে রীতিমতো বিস্মিত “সে কী! পিছনের সিটে বসেও সিটবেল্ট বাঁধতে হবে?” তখন হাসিমুখে চালকের জবাব, “অবশ্যই। মনে রাখবেন, সিঙ্গাপুর ইজ আ ফাইন সিটি।”
এখানে ‘ফাইন’ শব্দটি কিন্তু দ্ব্যর্থবোধক। একইসঙ্গে জরিমানা ও সুন্দর। পথ-বিধি ভাঙলে সিঙ্গাপুরে জরিমানা বাধ্যতামূলক এবং সিঙ্গাপুর একটি সুন্দর শহরে পরিণত হওয়ার অন্যতম কারণও এটাই।
উল্টো দিকে ওই কর্পোরেট-কর্তার নিজের শহর, সিঙ্গাপুর থেকে প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার দূরের কলকাতায় পথচলার আইন যথেচ্ছ ভেঙেও পথচারীরা দিব্যি পার পেয়ে যান। শহরের যানশাসনের দফারফা হওয়ার এটা অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করে কলকাতা পুলিশ। কিন্তু নিয়মভঙ্গকারী পথচারীদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করার বদলে পুলিশ এত দিন তাঁদের সচেতন করার উপরেই বেশি জোর দিয়েছে।
তবে এ ভাবে যে আর চলতে পারে না, লালবাজারের কর্তারা এখন সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন। বরাহনগর থেকে বেহালা, শহর জুড়ে এখন পুজোর বাজারের ভিড়। পথচলার নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করার বিষয়টি এখন চরমে উঠেছে পথচারীদের মধ্যে। |
এ বছর উৎসবের মরসুম শেষ হওয়ার পরে নিয়মভঙ্গকারী পথচারীদের কাছ থেকে জরিমানা আদায়ের অভিযানে কোমর বেঁধে নামার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে কলকাতা পুলিশ। জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা না পেরিয়ে অন্য জায়গা দিয়ে রাস্তা পেরোনোর জন্য জরিমানা করার পাশাপাশি মোবাইলে কথা বলতে বলতে রাস্তা পেরোনোর দায়েও জরিমানা হবে।
শুধু তা-ই নয়। লালবাজারের কর্তাদের মতে, পথচারীরা নিয়ম ভাঙলে তার জরিমানার পরিমাণ অত্যন্ত কম-- ন্যূনতম ১০ টাকা আর সর্বোচ্চ ৫০ টাকা। নিয়মভঙ্গকারী পথচারীর সেই সময়ে কতটা সামর্থ্য আছে, সেটা বুঝে ট্রাফিক সার্জেন্ট নিজের বিবেচনা অনুযায়ী জরিমানার অঙ্ক ঠিক করেন। কেন্দ্রীয় মোটরযান আইনে ‘জেওয়াকিং’ বা নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে খেয়ালখুশিমতো পথচলার জন্য জরিমানার পরিমাণ ধার্য করার ক্ষমতা রাজ্যগুলিকে দেওয়া হয়েছে। কলকাতায় পথচারীদের জরিমানার অঙ্ক ঠিক হয়ে আছে রাজ্য স্বরাষ্ট্র (পুলিশ) দফতরের ১০ বছর আগের এক নির্দেশের ভিত্তিতে। জরিমানার পরিমাণ বাড়াতে হলে নতুন নির্দেশ জারি করতে হবে।
পুলিশের হিসেবে, গড়ে রোজ ১৪ লক্ষ গাড়ি কলকাতার রাস্তায় যাতায়াত করে। আর রাস্তা দিয়ে হাঁটেন তার অন্তত পাঁচ গুণ বেশি মানুষ। পুলিশই জানাচ্ছে, পথচারীদের মধ্যে কয়েক লক্ষ মানুষ রোজ নিয়মভঙ্গ করেন। অথচ এ বছর জানুয়ারি থেকে অগস্টএই আট মাসে কলকাতায় মোট ২৬ হাজার ৯৮৫ জন নিয়মভঙ্গকারী পথচারীর বিরুদ্ধে ট্রাফিক পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে এবং তাঁদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হয়েছে ২ লক্ষ ২০ হাজার ১৭৫ টাকা। অর্থাৎ গড়ে এক এক জন নিয়মভঙ্গকারী পথচারীর কাছ থেকে আদায় করা জরিমানার পরিমাণ সওয়া আট টাকাও নয়! |
লালবাজারের এক শীর্ষকর্তার মতে, “জরিমানার অঙ্ক বাড়িয়ে এমন করা উচিত, যাতে এক বার নিয়ম ভেঙে জরিমানা দিলে আবার নিয়ম ভাঙার আগে কোনও পথচারী দু’বার ভাববেন। বহু ক্ষেত্রে পথচারীদের দোষেই দুর্ঘটনা ঘটে।”
এ বছর ফেব্রুয়ারিতে রক ব্যান্ড বিটল্স-এর সাতের দশকে সাড়া ফেলে দেওয়া অ্যালবাম ‘অ্যাবে রোডের’ কভারের ছবি পথচারীদের সচেতন করার অভিযানে সামিল করেছিল ট্রাফিক পুলিশ। সেই ছবিতে ছিল লন্ডনের অ্যাবে রোডের জেব্রা ক্রসিং দিয়ে সুশৃঙ্খল ভাবে হেঁটে যাচ্ছেন জন লেনন, রিংগো স্টার, পল ম্যাককার্টনি ও জর্জ হ্যারিসন। গোটা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে গোটা পঞ্চাশেক ট্রাফিক সিগন্যাল পোস্টে ওই ছবি দিয়ে কলকাতা পুলিশ পথচারীদের বলেছিল, ‘ইফ দে ক্যান, হোয়াই কান্ট ইউ? ওরা যদি পারে, তোমরা তা হলে পার না কেন?’ কলকাতা পুলিশের প্রচারে এ হেন অভিনব উদ্যোগ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে পর্যন্ত প্রচুর প্রশংসা কুড়িয়েছিল।
আর এখন লালবাজারের এক শীর্ষকর্তা স্বীকার করে নিচ্ছেন, “বিটল্স-এর অ্যালবাম সামনে রেখে প্রচারে ওই উদ্যোগের ক্ষেত্রে পথচারীদের কাছ থেকে আমাদের যতটা প্রত্যাশা ছিল, তা পূরণ হয়নি। কলকাতার পথচারীদের অধিকাংশই সাধারণ মানুষ। বিট্লস সম্পর্কে তাঁদের অনেকেরই ধারণা নেই।”
কলকাতা পুলিশের বিশেষ কমিশনার (২) সৌমেন মিত্র অবশ্য বলেন, “বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন ধরনের বিষয়কে আমাদের সচেতনতা প্রচারে আনা হয়। বিটল্স-এর অ্যাবে রোড-কে সামনে রেখে প্রচার একটি শ্রেণিকে মাথায় রেখে করা হয়েছে।”
হয়তো কাকতালীয়, কিন্তু বিটল্স-কে সামিল করে ট্রাফিক পুলিশের প্রচার শুরুর পরের মাস, মার্চে ৩৯৪৫ জন পথচারীর বিরুদ্ধে ট্রাফিক পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছিল। যা এ বছর কোনও একটি মাসে এখনও পর্যন্ত সর্বাধিক।
ডিসি (ট্রাফিক) দিলীপ আদকের বক্তব্য, “যানবাহনের সঙ্গে সঙ্গে পথে চলার নিয়ম যে তাঁদেরও মানতে হবে, সেই বোধটা পথচারীদের অধিকাংশের মধ্যে নেই।” ডিসি বলেন, “এটা ঠিক, কলকাতার সর্বত্র রাস্তার মোড়ে জেব্রা ক্রসিং নেই। কিন্তু যে সব জায়গায় আছে, সেখানেই বা ক’জন পথচারী জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করেন?”
ট্রাফিক পুলিশের এক অফিসারের কথায়, “নরম কথায় আবেদন-নিবেদন করে প্রচারে কিছু হবে না। কঠোর হতে হবে।” কিন্তু কবে থেকে তাঁরা কঠোর হবেন, সেটাই প্রশ্ন।
|
ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী, বিশ্বনাথ বণিক |
পুরনো খবর: গতি হ্রাসে দুর্গতি |