বুকের মাপ ৩৪ ইঞ্চি। কিন্তু তাঁর বুকের পাটার মাপ মেলা অত সহজ নয়।
তাই অচেনা কাউকে বাঁচাতেও মাঝগঙ্গায় ঝাঁপাতে পারেন সঞ্জয় সিংহ। এক মুহূর্তও ভাবেন না, মাঝগঙ্গার চোরা স্রোত তাঁকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। ভাবেন না, বাড়িতে স্ত্রী, ১৪ বছরের মেয়ে, ৪ বছরের ছেলে রয়েছে। শুধু অনুভব করেন, তাঁর ভিতরে কেউ যেন বলছে, ডুবন্ত মানুষটিকে বাঁচাতেই হবে।
বছর চল্লিশের সঞ্জয় রোজ সকালে হিন্দমোটরে প্রাতর্ভ্রমণের শেষে গঙ্গায় সাঁতার কাটেন। কিন্তু সেটা নদীর পাড়
|
সঞ্জয় সিংহ। |
বরাবর। তার সঙ্গে মাঝগঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়ার আকাশ-পাতাল তফাত। বুধবার অবশ্য সেই অভিজ্ঞতাও হয়েছে তাঁর। যে লঞ্চে তিনি ছিলেন, তাতেই যাচ্ছিলেন সুদীপ্ত দাস। বুধবার হাওড়া থেকে সকাল সাড়ে ন’টার লঞ্চে ওঠেন দু’জনেই। সুদীপ্তবাবুর কথায়, “লঞ্চে বেশ ভিড়। আচমকা শুনি, পিছনের দিকে হইহই। আমি সামনে ছিলাম। সামনের দিকে লঞ্চের যে কর্মী ছিলেন, তিনি ক্রমাগত ঘণ্টা বাজিয়ে লঞ্চ থামানোর চেষ্টা করছিলেন। মুখ বাড়িয়ে দেখি, মাঝগঙ্গায় এক জন খাবি খাচ্ছে।”
সুদীপ্তবাবু জানান, লোকটিকে পড়ে যেতে দেখে অন্য যাত্রীরা চিৎকার জোড়েন। তার পরেই এক জন চট করে জুতো খুলে ঝাঁপিয়ে পড়েন নদীতে। সাঁতরে পৌঁছে যান ডুবন্ত মানুষটির কাছে। সেই উদ্ধারকর্তাই সঞ্জয়। পরে লঞ্চের এক কর্মীও একটি টায়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন জলে।
সঞ্জয়ের কথায়, “আমি লঞ্চ থেকে লোকটির হাত দু’টো দেখতে পাচ্ছিলাম। আকাশের দিকে হাত ছুঁড়ে বাঁচার চেষ্টা করছিলেন। লঞ্চ ততক্ষণে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে গতি কমিয়েছে। কিন্তু মনে হচ্ছিল, হাতে সময় কম। তাই কারও উপরে ভরসা না করে ঝাঁপিয়ে পড়ি। পায়ের তলায় তখন জলের প্রবল স্রোত। প্রাণপণে সাইকেল চালানোর মতো করে পা চালাচ্ছি। আর এক হাত দিয়ে ডুবন্ত মানুষটির কোমরের বেল্ট ধরছি। কিন্তু তাতে তাঁর মাথা জলে ডুবে যাচ্ছিল। আবার জামার কলার ধরলে শার্টটা ফাঁসের মতো গলায় চেপে বসছিল।”
শেষে লঞ্চ থেকে ছুড়ে দেওয়া একটি টায়ারের সাহায্যে ওই সংজ্ঞাহীন ব্যক্তিকে লঞ্চে আনেন সঞ্জয়। কিছু পরেই জ্ঞান ফেরে ওই ব্যক্তির। খবর পেয়ে লঞ্চ চাঁদপাল ঘাটে ভেড়ার আগেই ওই ব্যক্তির অফিসের লোকেরা অপেক্ষা করছিলেন। সঞ্জয়ও ভিজে জামাকাপড়েই অফিসে যান। সহকর্মীরা তাঁর জন্য নতুন প্যান্ট-শার্ট কিনে আনেন। সহকর্মী দেবব্রত ঘোষের কথায়, “লঞ্চে তো আরও লোক ছিল। কিন্তু অন্য কেউ তো ঝাঁপিয়ে পড়েননি!”
আজকের শহুরে ব্যস্ত জীবনে এমন মানবিক মুখ খুঁজে পাওয়া ভার। রাস্তায় দীর্ঘক্ষণ পড়ে থেকে অসুস্থ ব্যক্তির মৃত্যু সংবাদপত্রে শিরোনাম হয় প্রায়ই। খুব কম সময়েই দেখা যায়, কোনও পথচারী, বা পুলিশকর্মী সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছেন। তাই এ দিনের ঘটনায় অভিভূত ওই লঞ্চের বাকি যাত্রীরা।
আদতে বিহারের বাসিন্দা, আড়াই বছর বয়স থেকে কলকাতায় মানুষ সঞ্জয় অবশ্য শান্তশিষ্ট বলেই বন্ধুমহলে পরিচিত। নদীতে লাফানোর আগে পরিবারের কথা মনে পড়েনি? হাল্কা হেসে সঞ্জয়ের স্বীকারোক্তি, “এক বার ভেবেছিলাম। কিন্তু সেটা মুহূর্ত মাত্র। পরক্ষণেই সামনে ডুবন্ত মানুষটির ছবি আগের ছবিটাকে ঝাপসা করে দেয়। সাঁতার জানা সত্ত্বেও এমন অসহায় ভাবে এক জনের মৃত্যু দেখব কী করে?” কোনও এক সহযাত্রী বোধ হয় সঞ্জয়ের হাত টেনে ধরে বাধা দেওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে তিনি মনস্থির করে ফেলেছেন, ডুবন্ত লোকটাকে বাঁচাতেই হবে। |