ধারণা আর বাস্তবের মধ্যে ফারাক হয়ে যাচ্ছে অনেকটাই।
ধারণা ছিল, রাস্তায় স্পিড ব্রেকার থাকলে দুর্ঘটনা কমবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে ঠিক তার উল্টোটা। দেখা যাচ্ছে, স্পিড ব্রেকারের জন্যই ঘটছে দুর্ঘটনা।
পথ দুর্ঘটনা কমাতে রাস্তায় স্পিড ব্রেকার তৈরির জন্য জনতার দাবি মেনে শহর জুড়ে তৈরি হয়েছে নানা উচ্চতার, নানা রকমের স্পিড ব্রেকার। কিন্তু এই স্পিড ব্রেকারের জন্যই প্রতিনিয়ত বিপদে পড়ছেন মানুষ। বাড়ছে দুর্ঘটনা।
মাস দেড়েক আগে গল্ফগ্রিনে বাস থেকে নেমে উদয়শঙ্কর সরণি দিয়ে রিকশায় চড়ে অফিসে যাচ্ছিলেন হাওড়ার বাসিন্দা নবনীতা রায়। দূরদর্শন ভবনের সামনে উঁচু স্পিড ব্রেকার পেরোতে গিয়ে গতি কমিয়েছিলেন রিকশাচালক। আচমকা পিছন থেকে একটি মোটরবাইক এসে ধাক্কা মারে। নবনীতা ছিটকে পড়েন রাস্তায়। তিনি বললেন, “পা ভেঙে প্রায় মাসখানেক শুয়ে থাকতে হয়েছিল আমাকে।” |
মাসখানেক আগে টালিগঞ্জের বাসিন্দা অপূর্ব সরকার গাড়ি নিয়ে প্রতাপাদিত্য রোড ধরে টালিগঞ্জের দিকে যাচ্ছিলেন। সন্ধ্যার পরে রাস্তা ফাঁকা পেয়ে কিছুটা গতি বাড়িয়েছিলেন তিনি। হঠাৎ তাঁর গাড়ি গিয়ে পড়ে সারি সারি স্পিড ব্রেকারের মধ্যে। আগে থেকে বুঝতে না পারায় ব্রেক কষার সময়ই পাননি তিনি। আচমকা গাড়ি লাফিয়ে উঠতে স্টিয়ারিং-এ মাথা ঠুকে যায় অপূর্ববাবুর। অল্পের জন্য বড়সড় দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে যান। তাঁর কথায়, “নিয়ম না মেনেই স্পিড ব্রেকার বসানো হয়েছে। অন্ধকারে কোনও ভাবেই ওই সারি সারি স্পিড ব্রেকার দেখা সম্ভব নয়।”
নবনীতা বা অপূর্ববাবুর মতো অভিজ্ঞতা কমবেশি সকলেরই। গাড়িচালকদের অভিযোগ, বাঘা যতীন বাজার সংলগ্ন রাজা সুবোধ মল্লিক রোড, উদয়শঙ্কর সরণি, যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনিউয়ের উপরে গিরিশ ঘোষের বাড়ি সংলগ্ন এলাকা এবং রাজাবাজারে স্পিড ব্রেকার তৈরি হয়েছে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। রাজারহাট এক্সপ্রেসওয়ের উপরেও একই কাণ্ড।
কিন্তু এ ভাবে শহর জুড়ে স্পিড ব্রেকার বসানোর কারণ কী?
লালবাজারের এক কর্তা জানাচ্ছেন, কোনও এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটলেই স্পিড ব্রেকার তৈরির দাবি তোলেন এলাকাবাসী। তাঁদের ধারণা, স্পিড ব্রেকার বসালে দুর্ঘটনা কমবে। সেই দাবি মেনেই ট্রাফিক পুলিশ স্পিড ব্রেকার তৈরির অনুমতি দেয়। পুরসভার মেয়র পারিষদ (রাস্তা) সুশান্ত ঘোষও বলেন, “আমরাও স্পিড ব্রেকার বসানোর পক্ষপাতী নই। কিন্তু বসতি এলাকায় মানুষের দাবি মেনে বাধ্য হয়েই স্পিড ব্রেকার তৈরি করতে হয়।” পুলিশ ও পুরকর্তাদের বক্তব্য, দুর্ঘটনা ঘটার পরে স্পিড ব্রেকার বসানোর প্রতিশ্রুতি না দিলে অনেক সময়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তাতেই আরও চাপ তৈরি হয়।
অভিযোগ, স্পিড ব্রেকার তৈরির নিয়মগুলি কোনও ক্ষেত্রেই মানা হয় না। লালবাজারের এক আধিকারিক জানান, সাধারণত স্পিড ব্রেকার খুব উঁচু করা যায় না। দু’দিকে ঢাল রাখতে হয়। যাতে সহজেই গাড়ির চালকদের চোখে পড়ে সে জন্য স্পিড ব্রেকারগুলি জেব্রা ক্রসিংয়ের মতো সাদা-কালো রং দিয়ে চিহ্নিত করে দিতে হয়। স্পিড ব্রেকার যেখানে থাকে, তার কিছুটা আগে সাইনবোর্ডও লাগাতে হয়। গাড়িচালকদের অভিযোগ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই নিয়ম মানা হয় না। |
|
|
প্রতাপাদিত্য রোড। |
উদয়শঙ্কর সরণি। |
|
এর ফলে কী ঘটছে?
কলকাতা পুলিশের এক ট্রাফিক কর্তা বলেন, “নিয়ম মেনে স্পিড ব্রেকারগুলি তৈরি হলে হয়তো দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। কিন্তু শহরের অধিকাংশ স্পিড ব্রেকারগুলি পুরসভা তৈরি করেছে এলাকার মানুষের কথা শুনে। কোনও নিয়মই মানা হয়নি। ফলে উল্টে দুর্ঘটনা বাড়ছে।”
তাই প্রশ্ন উঠেছে, নিয়ম না মেনে তৈরি স্পিড ব্রেকারগুলি ট্রাফিক পুলিশ ভেঙে দেয় না কেন?
লালবাজারের ট্রাফিক কর্তাদের দাবি, “সাধারণ মানুষের চাপে পড়ে দাবি মেনে আমাদের ওই স্পিড ব্রেকার তৈরির অনুমতি দিতে হয়। ভাঙতে গেলেও বাসিন্দাদের রোষের মুখে পড়তে হয়। স্থানীয় চাপের কাছে নতিস্বীকার করা ছাড়া আর উপায় থাকে না।”
শুধু দুর্ঘটনা নয়, অতিরিক্ত স্পিড ব্রেকার বসানোর ফলে ওই সব রাস্তাতে গাড়ির গতিও কমে যায়। পরিবেশকর্মীদের বক্তব্য, এতে বেড়ে যায় দূষণের মাত্রা। পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বলেন, “কলকাতা শহরে রাস্তার ৭০ শতাংশ দূষণ গাড়ি থেকে ছড়ায়। বেশি স্পিড ব্রেকার থাকার ফলে বারবার ব্রেক কষতে হয়। তাতে দূষণের মাত্রা আরও বাড়ে।” সুভাষবাবুর বক্তব্য, “কলকাতার কোনও রাস্তায় স্পিড ব্রেকার বসানোর দরকার আছে বলেই আমি মনে করি না। কিছু মানুষের ভ্রান্ত ধারণার জন্য স্পিড ব্রেকার বসিয়ে বিপদ আরও বাড়ানো হচ্ছে।” |
ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক ও দেবস্মিতা চক্রবর্তী।
|