রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে পুর-বাজারের জায়গায় এখন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বিশাল লেক মল। বাজারটি সংস্কার করেছে এক বেসরকারি সংস্থা। এখানে-ওখানে ঝুলে থাকা তার আশ্রয় নিয়েছে কেব্লের মধ্যে। রয়েছে অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থাও। ঝাঁ-চকচকে নতুন মলে ঢুকলেই শহরের অন্য বাজারগুলির অবস্থা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। দুইয়ের মধ্যে এখন আকাশ-পাতাল ব্যবধান!
যেমন, শিয়ালদহের সূর্য সেন মার্কেট। ছ’মাস আগে এই বাজারে অগ্নিকাণ্ডের স্মৃতি এখনও অমলিন। দাউ দাউ করে জ্বলছে চার দিক। বেরোনোর পথ নেই। সেই জতুগৃহে পুড়ে মৃত্যু হয়েছিল ২১ জনের। কলকাতার আর কোনও বাজারে এমন অগ্নিকাণ্ড এড়াতে নির্দেশিকা তৈরি হয়েছিল এর পরেই। বিভিন্ন বাজারের অবস্থা দেখতে তৈরি হয়েছিল পরিদর্শক দল। বলা হয়েছিল, সূর্য সেন মার্কেট নতুন করে গড়ে তোলার সময়ে অগ্নিবিধি পুরোপুরি মেনে চলা হবে। |
বাজারে বাজারে পরিদর্শন হয়েছে পরবর্তী কয়েক মাস। কিন্তু সূর্য সেন মার্কেট পুনর্নির্মাণের সময়ে ব্রাত্যই থেকে গিয়েছে দমকলের বিধি। সেখানে অনেক দোকান খুলেছে। দিনের বেলাতেও জ্বলছে আলো, চলছে পাখা। বেশ কয়েকটি দোকানে বেআইনি ভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। সিইএসসি জানিয়েছে, বেআইনি ভাবে হুকিং করে বিদ্যুৎ ব্যবহার হচ্ছে ওই বাজারে। তাতে যে কোনও সময়ে ফের বড়সড় অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা সিইএসসি-র কর্তাদের। সে কথা পুর-প্রশাসনকে জানিয়েও দিয়েছেন তাঁরা। পুরসভার বাজার বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এখনও দমকল ছাড়পত্রই দেয়নি ওই সব দোকানকে। তাই সিইএসসি-ও বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়নি।
২১ জনের স্মৃতি বয়ে বেড়ানো সূর্য সেন মার্কেটেরই যদি এই হাল হয়, তা হলে অন্য বাজারগুলির অবস্থাটা কী? শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণে বাজার পরিদর্শনে যে ছবিটা বেরিয়ে এসেছে, তা কিন্তু মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। পুর-কর্তৃপক্ষও যে বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তা বিভাগীয় মেয়র পারিষদ তারক সিংহের কথাতেই পরিষ্কার। তারকবাবু বলেছেন, “নিউ মার্কেটের একাংশ, পার্ক সার্কাস, রামলাল বাজার, শ্যামবাজার, শ্রীমানি মার্কেট ও যদুবাবুর বাজারের অবস্থা ভাল নয়। কোথাও বিদ্যুৎ সংযোগের তার এলোমেলো এবং বিপজ্জনক ভাবে ছড়িয়ে। কোথাও ভেঙে পড়েছে বাড়ির পরিকাঠামো। যে কোনও মুহূর্তে দুর্ঘটনার আশঙ্কা তাই থেকেই যাচ্ছে।”
শহরে পুরসভার নিজস্ব বাজার রয়েছে ৪৬টি। বেসরকারি বাজারের সংখ্যা ৩১২। সূর্য সেন মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের পরে শহরের বাজারগুলির পরিকাঠামো ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা যাচাই করে দেখার নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। |
তখন তিনি বলেছিলেন, “বাজারে আগুন রোখার কোনও ব্যবস্থা নেই। ঢোকা-বেরোনোর ব্যবস্থা নেই। শুধু মোটা টাকা দিয়ে পুরসভা থেকে লাইসেন্স বেরিয়ে যাচ্ছে।”
তার পরেই পুরসভা, দমকল, সিইএসসি ও পুলিশ যৌথ ভাবে ওই ৩৫৮টি বাজার ঘুরে এক সমীক্ষা করে। সমীক্ষা শেষে আপাতত ২৭৭টির বাজারের রিপোর্ট তৈরি হয়েছে। তাতে দেখা গিয়েছে, শহরের ১৪৫টি বাজারের অবস্থা অত্যন্ত বিপজ্জনক। তুলনায় ভাল অবস্থায় রয়েছে ১৩২টি।
সমীক্ষার মূল বিষয় ছিল বাজার ভবনের হাল, বিদ্যুৎ সংযোগ ব্যবস্থা, হুকিং বা ট্যাপিং করা আছে কি না, নিয়ম মাফিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রয়েছে কি না, আগুন লাগলে বাজার থেকে বেরোনোর ব্যবস্থা আছে কি না, বাজারের ভিতরে রান্না করা হয় কি না, খাবার জলের ব্যবস্থা আছে কি না এবং শৌচাগার রয়েছে কি না। সমীক্ষার রিপোর্টে যে চিত্র উঠে এসেছে, তাতে রীতিমতো শঙ্কিত পুর-কর্তৃপক্ষ। পুরসভার এক পদস্থ অফিসারের কথায়, “ওই রিপোর্ট ধরে ব্যবস্থা নিতে শুরু করলে অধিকাংশ বাজারের ঝাঁপ এখনই বন্ধ করে দিতে হবে।”
শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ের কাছেই শ্যামবাজার মার্কেট। বেসরকারি ওই বাজারে প্রতিদিনই হাজারখানেক মানুষ শাক-সব্জি, মাছ-মাংস সহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে আসেন। ভাঙাচোরা বাড়ি, ফুটিফাটা মেঝে নোংরা জলে ভর্তি। বাজার ভর্তি ব্যাগ নিয়ে সেখান দিয়ে হাঁটাচলা করাই দুষ্কর। এর উপরে যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে বিদ্যুতের তার। শট সার্কিট হলে ফের আর একটা সূর্য সেন কিংবা হাতিবাগান হয়ে উঠতেই পারে।
দক্ষিণ কলকাতার পার্ক সার্কাসে পুরসভার নিজস্ব বাজার। ভিতরে স্তম্ভগুলির অবস্থা এতই খারাপ যে ব্যবসায়ীরা সব সময়ে আতঙ্কে থাকেন। এক সব্জিবিক্রেতার কথায়, “কী আর করব? এই দোকান থেকেই সংসার চলে। ভয়ে তো দোকান ছেড়ে চলে যেতে পারি না!” তাঁর ক্ষোভ, “পুরসভাকে মাসে মাসে ভাড়া দিচ্ছি। সারানোর দায়িত্ব তো ওদেরই।” একই ছবি কসবার রামলাল বাজার ও ভবানীপুরে যদুবাবুর বাজারেও।
দমকলের এক পদস্থ অফিসার বলেন, “প্রতিটি বাজারকে আমাদের অগ্নি-নির্বাপক বিধি মানতে হবে। না হলে বিপদের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। আমাদের ব্যবস্থা নিতে বললে আমরা শহরের প্রায় ২০০টি বাজার এখনই বন্ধ করে দিতে বলব। আমাদের অনুমোদন ছাড়া যে বাজারগুলি চলছে, সেগুলির ক্ষেত্রে দমকলের কোনও দায়িত্ব নেই। কিন্তু অনুমোদিত বাজারগুলি বিধি মেনে চলছে কি না, তা দেখার মতো পরিকাঠামো কিন্তু আমাদের নেই।” |
নিউ মার্কেটে ফুলবাজারের ছাদের হাল হাল দেখে রীতিমতো শঙ্কিত খোদ মেয়র পারিষদ (বাজার) তারকবাবু। তাঁর কথায়, “ও সব দেখেই মনে হয়েছিল, বড়সড় বিপদ ঘটে যাওয়ার আগে এখনই কিছু করা দরকার। সেই মতো মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে বিষয়টি জানানো হয়।” তারকবাবু জানান, শহরের কয়েকটি বাজার সংস্কারের কাজে পুরসভা এক কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। ইতিমধ্যেই বেহালার এস এন রায় মার্কেটের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। নিউ মার্কেট, পার্ক সার্কাস ও রামলাল বাজারের কাজ খুব শীঘ্রই শুরু হবে।
সূর্য সেন মার্কেটের অগ্নিকাণ্ডের পরেই কলকাতার বাজারগুলির সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লেক মার্কেট ছাড়া অন্য বাজারগুলির অবস্থা তার পরেও যে খুব একটা পাল্টায়নি, সে ব্যাপারে তিনি নিজেও অবগত। মুখ্যমন্ত্রী চান, বেসরকারি বাজারগুলির সংস্কারে সংশ্লিষ্ট বাজার সমিতিগুলি উদ্যোগী হোক। পুরসভা বা সরকারের পক্ষে ওই বাজারগুলিতে কোনও কিছু করতে যাওয়াটা ঠিক হবে না বলেই মনে করেন তিনি। কোন বাজারে কত জন দোকানদার রয়েছেন, তার হিসেব রয়েছে বাজার সমিতির কাছেই। সরকার পিছন থেকে তাদের সংস্কার পর্বে সাহায্য করতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন, পুর-বাজারগুলির সংস্কারের ক্ষেত্রে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। লেক মলের অভিজ্ঞতা অন্য পুর-বাজারগুলির ক্ষেত্রেও কাজে লাগানোর চেষ্টা হবে।
|
ছবি: রণজিৎ নন্দী ও স্বাতী চক্রবর্তী। |
পুরনো খবর: গতি হ্রাসে দুর্গতি |