সময়ে শক্ত হাতে হাল ধরলে এতটা বাড়াবাড়ি হত না বলেই মনে করেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন। আচার্য হিসেবে মঙ্গলবার তিনি কলকাতা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাদের রাজভবনে ডেকে নিয়ে তাঁর এই মনোভাব স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন।
রাজভবন সূত্রের খবর, রাজ্যের প্রথম সারির দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে পরপর ঘেরাও, বিক্ষোভ ও বিশৃঙ্খলার ঘটনায় রাজ্যপাল উদ্বিগ্ন। দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়েই যে ভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা হয়েছে, তাতে তিনি মোটেই খুশি নন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির হাতে যে ক্ষমতা রয়েছে, তা প্রয়োগ করলে এ ভাবে উপাচার্যদের এত ক্ষণ ধরে ঘেরাও হয়ে থাকতে হত না বলেও মনে করেন নারায়ণন। দুই উপাচার্যের কাছে তিনি তাঁর এই মনোভাব স্পষ্ট করে দিয়েছেন বলে রাজভবন সূত্রের খবর। |
রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করার পরে দুই উপাচার্য।
যাদবপুরের শৌভিক
ভট্টাচার্য এবং কলকাতার সুরঞ্জন দাস। ছবি: সুদীপ আচার্য। |
গত সপ্তাহে র্যাগিংয়ের অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত দুই ছাত্রের শাস্তি মকুবের দাবিতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল ছাত্রছাত্রী উপাচার্য, সহ-উপাচার্য এবং রেজিস্ট্রারকে টানা ৫০ ঘণ্টা ঘেরাও করে রাখেন। উপাচার্য সিদ্ধার্থ দত্ত এতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর পর সোমবার রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজে বি-টেকের ছাত্রছাত্রীরা প্লেসমেন্টের দাবিতে রাতভর ঘেরাও করে রাখেন উপাচার্য, সহ-উপাচার্য (শিক্ষা), রেজিস্ট্রার এবং বিজ্ঞান বিভাগের সচিবকে। উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার ঘেরাও হয়ে ছিলেন ১১ ঘণ্টা। অন্য দুই আধিকারিক ১৭ ঘণ্টা। মঙ্গলবার ভোর পাঁচটা নাগাদ ঘেরাওমুক্ত হন তাঁরা। এই ঘেরাওয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ায় উপাচার্য সুরঞ্জন দাসকে দিল্লি যাওয়ার কর্মসূচি বাতিল করতে হয়।
রাজভবন সূত্রের খবর, নারায়ণন মনে করেন, দুই ক্ষেত্রেই উপাচার্যদের উচিত ছিল যথোপযুক্ত ও কড়া ব্যবস্থা নিয়ে পরিস্থিতি সামলে নিজেদের ঘেরাওমুক্ত করা। রাজাবাজার ক্যাম্পাসে যে দারোয়ানের কাছ থেকে চাবি নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা মূল ফটকে তালা ঝুলিয়েছিলেন, তাঁকে শো-কজ করা যেত, কিন্তু তা হয়নি। দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তারা অবশ্য এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
তবে যে ভাবে দুই বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষই শেষ পর্যন্ত ছাত্রদের অন্যায় দাবির কাছে মাথা না নুইয়ে নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন তার প্রশংসা করেন রাজ্যপাল। এপ্রিল মাসে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার ঘটনাতেই আচার্য বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও রকম অশান্তি বা বিশৃঙ্খলা বরদাস্ত করতে তিনি রাজি নন। সেই সময়ই ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি ক্যাম্পাসে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য পুলিশের সাহায্য নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
এ দিনও কি তিনি দুই উপাচার্যকে ওই একই পরামর্শ দিয়েছেন?
রাজ্যপালের সঙ্গে দু’ঘণ্টা বৈঠক সেরে বেরিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস এবং যাদবপুরের উপাচার্য শৌভিক ভট্টাচার্য জানান, আচার্যও মনে করেন ঘেরাওকে কোনও ভাবেই সমর্থন করা যায় না। ক্যাম্পাসে কী ভাবে শান্তি বজায় রাখা যায়, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এই সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণ করা হবে বলেও কথা হয়েছে এ দিনের বৈঠকে। যদিও সেটা কী ভাবে, তা স্পষ্ট করে বলতে চাননি কোনও উপাচার্যই।
সুরঞ্জনবাবু বলেন, “ক্যাম্পাসে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা ও দরকারে পুলিশি সাহায্য নেওয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু রাজ্যপাল এ নিয়ে কোনও পরামর্শ দেননি। ক্যাম্পাসে পুলিশ ডাকা হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেবে বিশ্ববিদ্যালয়ই। যদিও উপাচার্য হিসেবে আমি কখনওই পুলিশ দিয়ে ক্যাম্পাসে শৃঙ্খলা বজায় রাখার পক্ষপাতী নই।”
যাদবপুরের উপাচার্য শৌভিক ভট্টাচার্য, সহ-উপাচার্য সিদ্ধার্থ দত্তের কাছে এ দিন র্যাগিংয়ের ঘটনা, তার তদন্ত ও শাস্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে চান রাজ্যপাল। একই ভাবে তিনি ঘেরাওয়ের কারণ জানতে চান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস ও সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) ধ্রুবজ্যোতি চট্টোপাধ্যায়ের কাছে।
রাজভবন থেকে বেরিয়ে শৌভিকবাবু বলেন, “রাজ্যপাল আবার আমাদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলতে থাকবে।” সুরঞ্জনবাবুর বক্তব্য, কর্মী বা ছাত্রদের দাবিদাওয়া জানানোর জন্য নির্দিষ্ট গণতান্ত্রিক পদ্ধতি আছে। তা না করে ঘেরাও, অবরোধের পথে গিয়ে ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিই ক্ষুণ্ণ করছেন। তাঁর কথায়, “মানবাধিকার কমিশন তো স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে অনেক ঘটনারই তদন্ত করে। আমাদের আটকে রাখায় যে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হল, কমিশন তারও তদন্ত করুক।” রাজ্যপালকেও তিনি এ কথা জানিয়েছেন।
ক্যাম্পাসিংয়ের দাবিতে সোমবার দুপুর দু’টো থেকে ঘেরাও শুরু করেন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের বি-টেক ছাত্রছাত্রীরা। তাঁদের অভিযোগ, ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে মাত্র ৩৮ জন ক্যাম্পাসিংয়ের মাধ্যমে চাকরি পেয়েছেন। তার আগের বছরগুলিতে অবস্থা এতটা খারাপ ছিল না। বর্তমানে ক্যাম্পাসিংয়ের দায়িত্বে থাকা প্লেসমেন্ট কো-অর্ডিনেটরকে সরিয়ে ওই জায়গায় নতুন অফিসার নিয়োগ করতে হবে। সোমবারই উপাচার্য জানিয়েছিলেন, স্থায়ী প্লেসমেন্ট অফিসার নিয়োগের ইন্টারভিউ হবে ৭ অক্টোবর। তা সত্ত্বেও রাতভর আটকে রাখা হয় কর্তাদের। এমনকী, মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে ক্যাম্পাসের ভিতরে থাকা গাড়িগুলিকেও আটকে রাখা হয়।
উপাচার্য সে দিনই বলেছিলেন, “ক্যাম্পাসিংয়ের দাবিতে এই ভাবে আন্দোলনের ফলে ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্কে কী ধারণা তৈরি হবে সংস্থাগুলির?” উপাচার্যের আশঙ্কা যে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়, আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের একাংশের কথাতেও তা পরিষ্কার। মঙ্গলবার এক ছাত্রী বলেন, “নিজেদের দাবি জানানোটাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। ঘেরাও করে হিংসাত্মক আন্দোলন আমরা করতে চাইনি। কিন্তু কিছু পড়ুয়া ওই পথেই যেতে চাইল বলে আন্দোলনটা এই চেহারা নিল।”
যাদবপুরে এবং রাজাবাজারে ঘেরাও চলার সময়ই আন্দোলনের এই পদ্ধতির বিরোধিতা করেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। মঙ্গলবার বেথুন কলেজে একটি অনুষ্ঠানের পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ব্রাত্যবাবু বলেন, “ছাত্রছাত্রীরা প্রাপ্তবয়স্ক। কিন্তু শুধু প্রাপ্রবয়স্ক হলেই হবে না, তাঁদের প্রাপ্তমনস্কতারও পরিচয় দিতে হবে। আশা করছি আর ঘেরাও হবে না। ছাত্রছাত্রীদের দাবি থাকতেই পারে। সেই দাবিগুলি ন্যায্যও হতে পারে। কিন্তু তাঁরা উচ্চ শিক্ষা সংসদ কিংবা উচ্চ শিক্ষা দফতরকে না জানিয়ে প্রথমেই ঘেরাওয়ের মতো চরম পদক্ষেপ করছেন। এটা কাম্য নয়।”
|