কর্তৃপক্ষ অনড়ই, ৫০ ঘণ্টা পরে ঘেরাওমুক্ত যাদবপুর
বশেষে ঘেরাওমুক্ত হলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রার। টানা ৫০ ঘণ্টা পরে! এবং নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থেকেই।
র‌্যাগিংয়ে অভিযুক্ত দুই ছাত্রের শাস্তি পুনর্বিবেচনার দাবিতে বুধবার বিকেল পাঁচটা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন কর্তাকে ঘেরাও করে রাখেন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রেরা। বৃহস্পতিবার যোগ দেন কলা শাখার ছাত্র সংসদের সদস্যেরাও। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে নিজেদের ঘরেই আটকে পড়েন তিন কর্তা। সদর দরজা আটকে বসে স্লোগান দিতে থাকেন ছাত্রেরা। আন্দোলনকারীরা কেউই ক্লাস করেননি। শুক্রবার সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত টানা ৫০ ঘণ্টা এটাই ছিল প্রশাসনিক ভবনের চিত্র। এ দিন সন্ধ্যা সাতটার পরে সদর দরজার বাইরের দৃশ্যের তেমন পরিবর্তন না ঘটলেও ভিতরের ছবিটা ছিল অন্য। কারণ, সাতটাতেই তাঁদের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার।
টানা ঘেরাওয়ে বৃহস্পতিবারেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন সহ-উপাচার্য সিদ্ধার্থ দত্ত। কিন্তু উপাচার্য শৌভিক ভট্টাচার্য ও রেজিস্ট্রার প্রদীপ ঘোষকে ছেড়ে তিনি বাড়ি যেতে চাননি। প্রশাসনিক ভবনে তাঁর ঘরে গিয়েই চিকিৎসক সহ-উপাচার্যের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। তিন কর্তাকে ঘেরাওমুক্ত করতে বৃহস্পতিবার সারা দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন জুটা আন্দোলনকারী ছাত্রদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা চালালেও ফল হয়নি। আন্দোলনকারীরা ভেবেছিলেন, চাপের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ নতি স্বীকার করবেন। অন্য সময়ে যা হয়ে থাকে। কিন্তু বৃহস্পতিবারই সহ-উপাচার্য সিদ্ধার্থ দত্ত জানিয়ে দিয়েছিলেন, “আমরা সিদ্ধান্ত থেকে এক চুলও নড়ব না।”
শুক্রবারও কর্তৃপক্ষ সেই মনোভাবে অটল থাকায় শেষ পর্যন্ত পিছু হটে ঘেরাও তুলে নিতে বাধ্য হন আন্দোলনকারী ছাত্রেরা। একেই বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষের কড়া অবস্থান, তার উপরে বিভিন্ন মহলের সমালোচনার (বিশেষ করে প্রাক্তন ছাত্র নেতাদের) মুখে নিজেদের আন্দোলনের পথ বদল করেন ছাত্রেরা। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু-সহ জুটা নেতারা ঘেরাও আন্দোলন তুলে নেওয়ার অনুরোধ করেন ছাত্রদের। তাতে কিছুটা ফলও হয়। বৃহস্পতিবার বেলা বারোটার পর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্লাস বয়কট করা হয়েছিল। এ দিন অবশ্য বেশির ভাগ ছাত্রই ক্লাস করেছেন। পরিস্থিতির যে পরিবর্তন হচ্ছে, তা বুঝে যান ঘেরাও হয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তারাও। দুপুরে সহ-উপাচার্য সিদ্ধার্থ দত্ত বলেন, “আশা করছি ওরা (আন্দোলনকারীরা) আমাদের বক্তব্য বুঝতে পেরেছে। সমস্যা দ্রুত মিটে যাবে বলে আমরা আশাবাদী।”
এ দিন বিকেল থেকেই সুর অনেকটা নরম করে ছাত্র নেতাদের কেউ কেউ বলেন, “আমরা তো ঘেরাও করিনি। গেটের সামনে অবস্থান করছি মাত্র। ওঁরা আমাদের উপর দিয়েই বেরিয়ে যেতে পারেন। আমরা বাধা দেব না।” সন্ধ্যার পরে সেই অবস্থান থেকেও সরে আসেন আন্দোলনকারীরা। সাতটা নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষীদের ঘেরাটোপে প্রশাসনিক ভবনের সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসেন উপাচার্য, সহ-উপাচার্য এবং রেজিস্ট্রার।
ঘেরাও উঠে যাওয়ার পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য
শৌভিক ভট্টাচার্য (ডান দিকে) এবং সহ-উপাচার্য সিদ্ধার্থ দত্ত। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।
উপাচার্যেরা যখন বেরিয়ে যান, তখন আন্দোলনকারীরা কেউ বাধা না দিলেও দু’টি সারিতে দাঁড়িয়ে তাঁরা স্লোগান দিতে থাকেন। তিন কর্তা নিজেদের বাড়িতে চলে যাওয়ার পরেও আন্দোলনকারীরা অনেকেই জায়গা ছাড়েননি। তাঁরা রাত থেকেই রিলে অনশনে বসার কর্মসূচি নেন। ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র সংসদ ফেটসুর সাধারণ সম্পাদক শৌভিক মুখোপাধ্যায় বলেন, “যে ঘটনায় দুই ছাত্রকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, সেটি আদৌ র‌্যাগিং কি না, তা বিবেচনা করতে হবে এবং ওই দু’জনের শাস্তি পুনর্বিবেচনার জন্য ফের র‌্যাগিং বিরোধী কমিটির বৈঠক ডাকার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। না হলে রিলে অনশন চলবে।” তবে জুটার এক সদস্যের মন্তব্য, “মুখরক্ষার জন্য আন্দোনকারী ছাত্রদের আর কিছু করার ছিল না।” রাতে দেখা যায়, আন্দোলনকারীদের সংখ্যা কমছে। ফেটসুর তরফে বলা হয়, “১২ ঘণ্টা করে এক সঙ্গে ২০ জন অনশন করবেন।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের সল্টলেক ক্যাম্পাসের হস্টেলে দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রকে র‌্যাগিংয়ের অভিযোগে গত ১০ সেপ্টেম্বর অভিযুক্ত দুই ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু সেই শাস্তি অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ জানিয়ে তা পুনর্বিবেচনার দাবিতে বুধবার বিকেল পাঁচটা থেকে ঘেরাও আন্দোলন শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র সংগঠন ফেটসু। কলা শাখার ছাত্র সংসদ আফসু-ও এই আন্দোলনকে সমর্থন করে। যদিও কর্তৃপক্ষ বরাবরই জানান, নিজেদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার প্রশ্ন নেই। প্রয়োজনে ছাত্রদের আচার্য-রাজ্যপালের দ্বারস্থ হতে হবে।
যে কারণে এই আন্দোলন, প্রাক্তন ছাত্র নেতাদের অনেকেই তা সমর্থন করেননি। এসএফআই-এর প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক সইফুদ্দিন চৌধুরী বলেন, “ছাত্ররা গায়ের জোরে যা খুশি তা-ই করতে পারে না। কিন্তু এই সংস্কৃতিটা বেড়ে যাচ্ছে। মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। এটা তার-ই প্রতিফলন। মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলিও এই ঘটনার দায় এড়াতে পারে না।” প্রাক্তন নকশালপন্থী ছাত্রনেতা অসীম চট্টোপাধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে বলেন, “র‌্যাগিং একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কর্তৃপক্ষ ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”
ছাত্রদের এই আন্দোলনের কড়া নিন্দা করে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, “অরাজনৈতিক ছাত্র সংসদ যে আসলে সোনার পাথরবাটি, যাদবপুরেই তার নমুনা আমরা দেখতে পেলাম। কোনও রাজনৈতিক দল যুক্ত থাকলে তারা বড়জোর ৬-৮ ঘণ্টা ঘেরাও করবে। কিন্তু অরাজনৈতিক সংগঠন করছে ৪৮ ঘণ্টা! কোনও দলের নিয়ন্ত্রণ নেই। এ ভাবে ঘেরাও করে রাখা তো এক ধরনের ব্ল্যাকমেলিং!” পাশাপাশি শিক্ষামন্ত্রী মন্তব্য, “ছাত্রদের বুঝতে হবে, র‌্যাগিং কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাগিং বিরোধী কমিটিতে ছাত্রদের প্রতিনিধিও রয়েছে। সেই ছাত্র প্রতিনিধিরা শাস্তির সিদ্ধান্তের সময়ে কী করছিলেন, এ দিন সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই সেই প্রশ্ন তোলেন। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে বলা হয়, ১০ সেপ্টেম্বর র‌্যাগিং বিরোধী কমিটির বৈঠকে ছ’জন ছাত্র প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তার মধ্যে দু’জন ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার ছাত্র সংসদ ফেটসু-র প্রতিনিধি। ফেটসুর সাধারণ সম্পাদক শৌভিক মুখোপাধ্যায় শাস্তির সিদ্ধান্তে আপত্তি জানান। ফেটসুর (সল্টলেক ক্যাম্পাস) সহকারী সাধারণ সম্পাদক মিঠুন বিশ্বাস শুধু হস্টেল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন। অর্থাৎ ছাত্র প্রতিনিধিদের অধিকাংশই শাস্তির সিদ্ধান্তে সমর্থন জানিয়েছিলেন বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর।
রেজিস্ট্রার প্রদীপ ঘোষ জানান, ইউজিসি-র নিয়মে র‌্যাগিংয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার উপাচার্যের রয়েছে। উপাচার্য মনে করলে র‌্যাগিং বিরোধী কমিটিতে থাকা ছাত্র প্রতিনিধিদের না জানিয়েই শাস্তি দিতে পারেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ কোনও একতরফা সিদ্ধান্ত নেননি। র‌্যাগিং বিরোধী কমিটির বৈঠক ডেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাই ছাত্রদের এই আন্দোলনের কোনও যুক্তি নেই বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ। তাঁরা জানিয়েছেন, শাস্তি পুনর্বিবেচনা করার কোনও ক্ষমতা এখন আর র‌্যাগিং বিরোধী কমিটির নেই। যা করার বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য অর্থাৎ রাজ্যপালকেই করতে হবে। তিনি চাইলে শাস্তি পুনর্বিবেচনা করতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়। না হলে নয়।
বিরক্ত প্রাক্তন ছাত্রনেতারা
ছাত্ররা গায়ের জোরে যা খুশি করতে
পারে না। এই সংস্কৃতি বাড়ছে। প্রধান
দলগুলিও দায় এড়াতে পারে না।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে দল
ভিত্তিক ছাত্র সংগঠন না থাকাই ভাল।
সৈফুদ্দিন চৌধুরী
এসএফআইয়ের প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক
এই পরিস্থিতির দ্রুত নিরসন
চাই। মনে হয় দু’তরফ
একটু নমনীয় হলেই
সমস্যা মিটবে।
তাপস রায়
ছাত্র পরিষদের
প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি


কর্তৃপক্ষ ভুল করেছেন মনে হলে ছাত্ররা
হাইকোর্টে আসুক। ছাত্রাবস্থায় অনেক
আন্দোলন করেছি। আইন যে পথকে
সমর্থন করে না, সে পথে কখনও যাইনি।
অরুণাভ ঘোষ
প্রাক্তন ছাত্র পরিষদ নেতা


বয়স্কদের রাতের পর রাত ঘেরাও
করে রাখা অনুচিত। কারও কিছু হয়ে গেলে
ঘেরাওকারীদের কপালে দুঃখ আছে। ওদের
মা-বাবার উচিত ছেলেমেয়েদের বাড়ি নিয়ে যাওয়া।
গৌতম দেব
এসএফআইয়ের প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক
র‌্যাগিং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কর্তৃপক্ষ ঠিক করেছেন। ছাত্র-শিক্ষক
সম্পর্ক ঠিক রাখতে আলাদা কমিটি থাকা উচিত। শিক্ষকদের প্রশাসনিক
দায়িত্ব দিলে তা শিক্ষাক্ষেত্রের পরিবেশের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়।
অসীম চট্টোপাধ্যায়
প্রাক্তন নকশাল নেতা

পুরনো খবর:
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.