রাতভর ঘেরাও। কিন্তু সেই চাপেও র্যাগিংয়ের সাজা কমাতে রাজি নন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বরং ৩০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলা ঘেরাওয়ে অসুস্থ হয়ে পড়া সহ-উপাচার্য পর্যন্ত জানিয়ে দিলেন, “এর আগে ৫২ ঘণ্টা ঘেরাও থাকার অভিজ্ঞতা আছে। দেখা যাক, এ বার কী হয়! আমাদের সিদ্ধান্ত থেকে আমরা নড়ব না।” বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কঠোর অবস্থানের মধ্যেই শোনা গেল সাধারণ পড়ুয়াদের একাংশের কণ্ঠস্বরও। তাঁদের বক্তব্য, আন্দোলনের নামে এক দিকে র্যাগিংয়ের মতো অপরাধকে সমর্থন করা হচ্ছে। অন্য দিকে, এর ফলেই নষ্ট হচ্ছে পড়াশোনা এবং পরিবেশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সল্টলেক ক্যাম্পাসে দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রকে র্যাগিংয়ের অভিযোগ ওঠে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দুই চতুর্থ বর্ষের ছাত্রের বিরুদ্ধে। গত ১০ সেপ্টেম্বর দুই অভিযুক্তকে যথাক্রমে একটি ও দু’টি সেমেস্টারের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে হস্টেল থেকেও বরাবরের মতো বহিষ্কার করা হয় তাঁদের। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই আন্দোলনে নামে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র সংসদ ফেটসু। বুধবার বিকেল পাঁচটা থেকে তারা যাদবপুরের উপাচার্য শৌভিক ভট্টাচার্য, সহ-উপাচার্য সিদ্ধার্থ দত্ত এবং রেজিস্ট্রার প্রদীপ ঘোষকে ঘেরাও শুরু করে। ছাত্রদের দাবি, অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেওয়া এই শাস্তির সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে হবে। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার পর থেকে ক্লাস বয়কটও শুরু করে ফেটসু। বিকেল থেকে ফেটসু-র সঙ্গে যোগ দেন কলা বিভাগের ছাত্র সংসদ আফসু-র সদস্যদের অনেকে। গভীর রাত পর্যন্ত ঘেরাও ওঠেনি। |
সম্প্রতি রাজ্যে কয়েকটি র্যাগিংয়ের ঘটনায় কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছেন। গত মাসে র্যাগিংয়ের অভিযোগে পাঁচ পড়ুয়াকে বহিষ্কার করেন বেসু কর্তৃপক্ষ। এ মাসের ১৪ তারিখে আরামবাগের নেতাজি মহাবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একই অভিযোগে হস্টেল থেকে ২২ জনকে বহিষ্কার করেন। শ্রীরামপুরের টেক্সটাইল টেকনোলজি কলেজের ৪ ছাত্রকে র্যাগিংয়ের দায়ে গ্রেফতারও করে পুলিশ। কিন্তু এতটা কঠোর হওয়া সত্ত্বেও কি র্যাগিং নিয়ে মনোভাব বদলানো সম্ভব হয়েছে? যাদবপুরে র্যাগিং সামলাতে কড়া নজরদারির ব্যবস্থা রয়েছে। ২০০৯, ২০১১, ২০১২-য় সেখানে র্যাগিংয়ের তিনটি ঘটনায় অভিযুক্তদের কড়া শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। সেই শাস্তির প্রতিবাদেও আন্দোলন হয়েছিল। তার পরেও যে ভাবে এ বারের ঘটনা ঘটেছে এবং যে ভাবে তাতে শাস্তি পাওয়া ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়ে ময়দানে নেমেছে দুই ছাত্র সংসদ, তাতে সংশয় রয়েই যাচ্ছে। উঁচু শ্রেণির ছাত্র, যাঁরা ঘেরাওয়ে যোগ দিয়েছেন, নতুনদের প্রতি তাঁদের একাংশ এই বার্তাও দিয়েছেন: হস্টেলে এমনটা আমরাও সহ্য করেছি! তোমাদের ক্ষেত্রে আলাদা কী হবে!
ওই দুই সংসদের সদস্যদের দাবি, যে জন্য শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তা র্যাগিংয়ের ঘটনাই নয়। ঘটনার দিন উঁচু ক্লাসের পড়ুয়াদের সঙ্গে দ্বিতীয় বর্ষের ওই ছাত্রের তর্কাতর্কি হয়েছিল মাত্র। তার জেরে উঁচু ক্লাসের ছেলেরা যে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রটিকে মারধর করেছিলেন, তা মেনেও নিয়েও ঘেরাওকারীদের দাবি, এই ঘটনাকে র্যাগিং বলা যাবে না। ফেটসু-র সদস্য শুভব্রত দত্তের দাবি, “এটি আদৌ র্যাগিংয়ের ঘটনা নয়। তাই তা র্যাগিং বিরোধী কমিটির বিবেচ্য বিষয় বলে আমরা মনে করছি না। পুরো ঘটনাটি শৃঙ্খলারক্ষা কমিটিকে দিয়ে তদন্ত করানো হোক।” কোন কমিটি অভিযোগের বিচার করবে তা বলে দেওয়ার পাশাপাশি কী পদ্ধতিতে অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে, তা-ও কার্যত নির্দিষ্ট করে দিলেন এই আন্দোলনকারীরা। শুভব্রতর বক্তব্য, “অভিযুক্ত ছাত্রদের বক্তব্যও শুনতে হবে। তার পরে যদি দোষ প্রমাণিত হয়, তা হলে বিশ্ববিদ্যালয় যা শাস্তি দেবে, মেনে নেওয়া হবে।” আফসু-রও দাবি, ঘটনাটি র্যাগিং কি না, আগে তা বিচার করে দেখা হোক।
ঘেরাওকারীদের এই দাবি খারিজ করে সিদ্ধার্থবাবু বলেছেন, “দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রটি শুধু হস্টেল সুপারেরই দ্বারস্থ হননি, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) হেল্পলাইনেও র্যাগিংয়ের অভিযোগ জানিয়েছিলেন।” প্রসঙ্গত, র্যাগিংয়ের অভিযোগ উঠলে কড়া হাতে তা দমন করার নির্দেশ রয়েছে ইউজিসি-র। পুলিশে অভিযোগ জানানোর নির্দেশও দিয়ে রেখেছে তারা। সিদ্ধার্থবাবু জানান, এ ক্ষেত্রে ইউজিসি ঘটনার তদন্ত করে রিপোর্ট জমা দিতে বলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে। “আমরা সেই মতো একটি তদন্ত কমিটি গড়ে কাজ করেছি। তদন্তে অভিযুক্ত দুই ছাত্রের বিরুদ্ধে র্যাগিংয়ের প্রমাণ পাওয়ার পরেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
ঘেরাওকারীদের অভিযোগ, র্যাগিং-বিরোধী কমিটিতে থাকা ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে শাস্তির বিষয়ে কোনও আলোচনা করা হয়নি। শুধু তাঁদের ডেকে রায় শুনিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জবাবে রেজিস্ট্রারের বক্তব্য, উপাচার্য মনে করলে র্যাগিং বিরোধী কমিটির ছাত্র প্রতিনিধিদের না জানিয়েই শাস্তি দিতে পারেন। ইউজিসি-র নিয়ম অনুযায়ী র্যাগিংয়ের ঘটনায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তাঁর রয়েছে। |
৫২ ঘণ্টা ঘেরাও থাকার অভিজ্ঞতা আছে।
দেখা যাক,
এ বার কী হয়! আমাদের
সিদ্ধান্ত
থেকে আমরা নড়ব না।
সিদ্ধার্থ দত্ত
সহ-উপাচার্য
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় |
র্যাগিংয়ের দাওয়াই
• প্রথম বর্ষের ছাত্রদের আলাদা হস্টেলে রাখা
• প্রথম বর্ষের গোড়াতেই পড়ুয়াদের কাউন্সেলিং
• প্রত্যেক বিভাগের ছাত্রদের নিয়মিত কাউন্সেলিং
• কথা বলে পড়ুয়াদের মনের হদিস
রাখার দায়িত্ব নির্দিষ্ট শিক্ষককে |
|
দিনরাত টানা ঘেরাওয়ে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রার তিন জনই অল্পবিস্তর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। চিকিৎসক এসে তাঁদের দেখে গিয়েছেন। সহ-উপাচার্য সিদ্ধার্থবাবুর রক্তচাপ অনেকটা বেড়ে যাওয়ায় তাঁকে ঘুমের ওষুধ ও বিশ্রামের পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক। যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে ঘুম কী ভাবে সম্ভব, সেটাই প্রশ্ন। চিকিৎসক জানিয়েছেন, রেজিস্ট্রার প্রদীপবাবুর রক্তচাপও বেড়েছে আর কমেছে উপাচার্য শৌভিকবাবুর রক্তচাপ। উপাচার্য অবশ্য এ বিষয়ে কিছুই বলতে চাননি। তবে রেজিস্ট্রার প্রদীপবাবু বলেছেন, “রাতভর এই ঘেরাওয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়।”
একই সঙ্গে রেজিস্ট্রার জানিয়েছেন, ছাত্রছাত্রীরা যত আন্দোলনই করুন না কেন, তাঁদের দাবি মানা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে এখন আর সম্ভব নয়। তিনি বলেছেন, “তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ইউজিসি-র কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর পরেও ছাত্রছাত্রীদের শাস্তি নিয়ে কোনও আপত্তি
থাকলে তাঁরা আচার্য তথা রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের কাছে আবেদন জানাতে পারেন।”
অবশ্য যাদবপুরে এমন ঘটনা এই প্রথম নয়। সময়ে-অসময়ে বিভিন্ন দাবিদাওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের ঘেরাও-অবস্থান বেশ কয়েক বছর ধরেই কার্যত দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে। ২০০৫-এ শিক্ষক-নিগ্রহে অভিযুক্ত ৫ ছাত্রকে কড়া শাস্তি দেওয়ার প্রতিবাদে অনশনে বসেছিলেন কিছু ছাত্র। পুলিশ তাঁদের জোর করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস। অচলাবস্থা চলেছিল দীর্ঘদিন। তার রেশ ছড়িয়ে পড়েছিল কলকাতার বাইরেও।
এ বারের ঘটনায় র্যাগিংয়ে জড়িতদের শাস্তি ঘোষণার পরে গত বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর সল্টলেক ক্যাম্পাসে এক দফা বিক্ষোভ দেখিয়েছিল ছাত্রছাত্রীদের একটি দল। কারও কারও দাবি, সেই সময়ে তাঁদের কথা বিবেচনার আশ্বাস দিয়ে পরিস্থিতি সামলেছিলেন কর্তৃপক্ষ। এর পর সোমবার যাদবপুর ক্যাম্পাসে ফের একপ্রস্ত গোলমাল হয়। বুধবার বিকেল থেকেই শুরু হয়ে যায় লাগাতার ঘেরাও।
|