জঙ্গলের অধিকার চেয়ে আবেদন জানিয়েছিলেন পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি জঙ্গলবাসী। যার মধ্যে প্রায় ১০ হাজার দেখাই হয়নি। বাতিল হয়েছে প্রায় ৩৬ হাজার। আর শেষমেশ পাট্টা পেয়েছেন হাজার দেড়েকের কিছু বেশি।
পশ্চিম মেদিনীপুরে বনাধিকার আইন প্রণয়নের কাজ চলছে অত্যন্ত ঢিমেতালে। ফলে ক্ষোভ বাড়ছে আদিবাসীদের মধ্যে। প্রশাসনিক উদাসীনতাকেই দায়ী করছেন তাঁরা। আবার অনেক ক্ষেত্রেই নানা অজুহাতে পাট্টার আবেদন খারিজ করে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠছে। যদিও প্রশাসনের দাবি, নিয়মের বেড়াজালেই বাতিল হয়ে যাচ্ছে পাট্টার আবেদন। নতুন করে পাট্টা বিলির কাজে জোর দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পশ্চিম মেদিনীপুরের অতিরিক্ত জেলাশাসক অরিন্দম দত্ত। এতদিন ঢিলেমি কেন? উত্তর মেলেনি।
২০০৬ সালে বনাধিকারি আইন পাশ হয়। ২০০৮ সাল থেকে তার কাজও শুরু হয়ে যায়। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে জঙ্গল। ঝাড়গ্রাম মহকুমার ৮টি ব্লক ছাড়াও মেদিনীপুর সদর মহকুমার গড়বেতা ১, ২, ৩, মেদিনীপুর সদর, শালবনি, খড়্গপুর মহকুমার নারায়ণগড়, কেশিয়াড়িতেও রয়েছে জঙ্গল। ওই সব এলাকায় জঙ্গলের জমিতে বসবাস করছেন বহু মানুষ। প্রশাসনিক পরিসংখ্যান বলছে, জঙ্গলের জমিতে বসবাসকারী হিসাবে পাট্টা চেয়ে আবেদন জানিয়েছিলেন ৫৩ হাজার ৫৪৫ জন। পরীক্ষা করা হয়েছে ৪৩ হাজার ৭৫৯ জনের। অর্থাৎ এখনও ৯৭৮৬ জনের আবেদনপত্র পরীক্ষা করা যায়নি! আবার যাঁদের আবেদনপত্র পরীক্ষা করা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে প্রায় ৩৬ হাজার ৩৫১ জনের আবেদন বাতিল হয়েছে। গৃহীত হয় ৭৩৯৮টি। তাঁদের ১৬২৫ একর জমির পাট্টা দেওয়া হয়েছে।
কেন ওই বিপুলসংখ্যক আবেদনপত্র খারিজ হয়ে গেল?
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, নিয়মের জটেই এমন পরিস্থিতি। তফসিলিদের জন্য জঙ্গলের জমি পাট্টা দেওয়ার নিয়ম হল ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসের আগে থেকে সংশ্লিষ্ট জমিতে তাঁকে বসবাস করতে হবে। আর যাঁরা তফসিলি নন, তাঁদের ক্ষেত্রে তিন পুরুষ ধরে সেই জমিতে বসবাস করতে হবে (বছর হিসাবে ৭৫ বছর ধরা হয়েছে)। প্রমাণ-সহ প্রথমে গ্রাম সংসদে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আবেদন করতে হবে। তারপর তা ব্লকস্তরে পাঠানো হবে। ব্লক থেকে জেলাস্তরে অনুমোদন পেলেই পাট্টা দেওয়া হবে। যাঁরা এই সংক্রান্ত নথি দেখাতে পারেননি, তাঁদেরই আবেদন খারিজ করা হয়েছে। রূপনারায়ণ ডিভিসনের ডিএফও রবীন্দ্রনাথ সাহার দাবি, “আমরা অকারণে কারও আবেদন খারিজ করি না। কিছু ক্ষেত্রে আবেদনকারী যদি ১০ ডেসিমেল জমিতে বসবাস করে ২০-৩০ ডেসিমেল জমির দাবি করেন, সেক্ষেত্রে আমরা তদন্ত করে জমির পরিমাণ কমিয়েছি। তার বাইরে নথির অভাবে গ্রাম সংসদেই বেশির ভাগ আবেদন বাতিল করা হয়েছিল।”
মেদিনীপুর লোধা শবর কল্যাণ সমিতির সম্পাদক বলাই নায়েক অবশ্য বলেন, “লোধারা তো জঙ্গলেই থাকে। পূর্বপুরুষ ধরেই জঙ্গলের বাসিন্দা। হাতে গোনা কয়েকজনকে পাট্টা দেওয়া হলেও যতটা পরিমাণ জমিতে বাড়ি তৈরি করেছিলেন, চাষ করতেন, সেই পরিমাণ জমিও দিচ্ছে না সরকার। গুটিকয় ব্যক্তিকে অতি সামান্য জমি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে, বনাধিকার আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে। আগের সরকার এই পথেই চলেছিল। বতর্মান সরকার তো কিছুই করছে না। গরিব লোধারা বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে।” মাঝি মাডওয়া জুয়ান গাঁওতার সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক প্রবীর মুর্মুরও অভিযোগ, “দীর্ঘ দিন ধরে আদিবাসীদের জঙ্গলের অধিকার নিয়ে আন্দোলন চললেও বাস্তবে পরিস্থিতির বিশেষ হেরফের হয়নি।”
প্রশাসন আশ্বাস দিচ্ছে, যে সমস্ত আবেদন এখনও পড়ে রয়েছে দ্রুত সেগুলি খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ করা হবে। মুখ্যমন্ত্রীর আসন্ন জেলা সফরের মধ্যে ৩২৩ জনকে পাট্টা দেওয়ার ব্যাপারেও পদক্ষেপ শুরু হয়েছে।
প্রশাসনের এই উদ্যোগ কতটা আন্তরিক, কতটা ঠেলায় প্রশ্নটা রয়েই যায়।
|