কোথাও ভূমি সংস্কার দফতরের অনুমতি ছাড়া কারখানা হয়েছে, কোথাও ধোঁয়া এবং বর্জ্যে লাগোয়া এলাকায় দূষণ ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। স্পঞ্জ আয়রন কারখানার একটা বড় অংশের বিরুদ্ধে এ রকম নানা অভিযোগ থাকলেও রমরমা কমেনি বর্ধমান-বাঁকুড়ায়। ফলে, প্রাণ ওষ্ঠাগত এলাকাবাসীর। কাদের জন্য এই পরিস্থিতি তা নিয়ে তৃণমূল এবং বিরোধী সিপিএম ব্যস্ত এখন চাপান-উতোরেই।
সম্প্রতি বিধানসভায় পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদার দাবি করেছেন, তৃণমূল-জমানায় গোটা রাজ্যে স্পঞ্জ আয়রন কারখানা থেকে বিভিন্ন দূষণের মাত্রা বাম আমলের চেয়ে ২০ শতাংশ কমেছে। কথাতেই ইঙ্গিত, দূষণ হচ্ছে।
দুর্গাপুর রেল স্টেশনের ৩ কিলোমিটারের মধ্যে তিনটি স্পঞ্জ আয়রন কারখানা আছে। তার আশপাশের বীরসিংহপুর, হরিরামপুর, শয়েরগ্রাম, আমশোল গ্রামের বাসিন্দাদের একটা বড় অংশের অভিযোগ, কারখানার বর্জ্য এসে পড়ছে তাঁদের জমিতে। স্থানীয় বাসিন্দা নিমাই ঘোষের দাবি, মাস চারেক আগে দূষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে তাঁরা একটি কারখানার সদর দরজা অবরোধ করেন। কিন্তু পুলিশ অবরোধ তুলতে গিয়ে গ্রামবাসীদের উপরে লাঠি চালায়। ২৩ জনকে গ্রেফতারও করা হয়। বনকাঠি, হরিয়ালপাড়া, নোদাডিহি, গোরানডিহি গ্রামের একাধিক বাসিন্দার দাবি, কারখানা থেকে উড়ে আসা ছাইতে ঢাকা পড়ায় তাঁদের ধান নষ্ট হচ্ছে। কালো হয়ে যাওয়া সে ধান বাজারে বিকোচ্ছে না বললেই চলে। প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন জানান, ২০০০ সাল থেকে স্পঞ্জ আয়রন প্রযুক্তি-নির্ভর শিল্পের আবেদন আসতে শুরু করে। শিল্পায়নের তাগিদে সেগুলি তাঁরা সেগুলোর অনুমোদন দেন। তবে পরে ওই শিল্প থেকে নির্গত দূষণের জন্য বাম সরকার কয়েকটি নির্দেশিকা তৈরি করে। তিনি বলেন, “নির্দেশিকা চালু করার পরেও দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। তবে তৃণমূল আমলেও তা নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছে বলে মনে করি না।”
রাজনীতির লোকেরা যা-ই বলুন, আখেরে মরে সাধারণ মানুষ, উপলব্ধি বাঁকুড়া ২ ব্লকের পাঞ্জা গ্রামের বৃদ্ধ চাষি ঝন্টু মাঝির। তাঁর কথায়, “২০০২ নাগাদ সিপিএমের নেতারা এসে বললেন, জমি দিয়ে দাও। কারখানা হবে। তোমাদের ছেলেপুলেরা কাজ পাবে। জমি না দিলে মারধরের ভয় ছিল। সেই নেতারাই এত দিন পরে এখন এসে বলছেন, ‘ওই কারখানা থেকে বিষ বেরোচ্ছে’। আবার তৃণমূল আগে কারখানার জন্য জমি দিতে বারণ করত। এখন তাদের দেখা মেলে না।”
দিল্লির একটি বেসরকারি সংগঠন ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’ (সিএসই) পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও ছত্তীশগঢ়ের ২০৪টি কারখানায় সমীক্ষা করে। দেখা গিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গে ৯২ শতাংশ কারখানায় ‘ইলেকট্রোস্ট্যাটিক প্রেসিপিটেটর’ (ইএসপি) যন্ত্র অকেজো। এটির মাধ্যমে বায়ু-দূষণ নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু কার্যত ওই যন্ত্র চালানো হয় না বা অকেজো করে রাখা হয় বলে অভিযোগ ওঠে কারখানার মালিকদের দিকে। পর্ষদের তরফেও ঠিকঠাক নজরদারি করা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান বিনয় দত্তের দাবি, “আসানসোল-দুর্গাপুরে আমাদের দফতর থেকে কারখানাগুলিতে বছরের নির্দিষ্ট সময় মেনে পরিদর্শন চালানো হয়।”
নিয়ম হল, এ সব কারখানার অনুমোদন দেওয়ার আগে সেগুলির পরিবেশগত প্রভাবের মূল্যায়ন (এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) করতে হবে। কোন কারখানায় ‘ইএসপি’ কাজ করছে, ডাঁই করে রাখা ছাঁট লোহা, কয়লার গুঁড়ো ছড়ানোর সম্ভাবনা আছে কি না, কিংবা বিস্ফোরক, ধুলো ও ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণের উপযুক্ত ব্যবস্থা, কর্মীদের নিরাপত্তা পোশাক ইত্যাদি রয়েছে কি না এবং মানুষের উপর দূষণের কী কী ও কতটা প্রভাব পড়ছে, সবই দেখার কথা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের। কোনও কারখানা দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধি না মানলে প্রথমে কারণ দর্শানোর নোটিস ও তার পরে কারখানা বন্ধের নোটিস পাঠায় পর্ষদ। কিন্তু “বিধিনিয়ম মেনে নেওয়া হয়েছে বলে আবেদন করে, বন্ধ কারখানাগুলি ফের চালু হয়ে যায়, নিয়ম-বিধি জলাঞ্জলি দিয়েই,” দাবি ‘নাগরিক মঞ্চ’ সংগঠনের নব দত্তর। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন আইন আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় জানান, স্পঞ্জ আয়রন কারখানার কঠিন বর্জ্য (ডলোমাইট, ছাঁট লোহা) থেকে দূষিত ধুলো ছড়িয়ে পড়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ জুড়ে। তাঁর দাবি, “সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, এই ধূলো শ্বাসের সঙ্গে শরীরে ঢুকলে টিবি, ফুসফুসের ক্যানসার, কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া, পেটের রোগ, অ্যালার্জির মতো নানা দীর্ঘস্থায়ী রোগ হয়।”
প্রশাসন সূত্রের খবর, ১ শতাংশেরও কম এ ধরনের কারখানার আকরিক লোহা বা কয়লা পাওয়ার লাইসেন্স রয়েছে। বাকিরা নিম্ন মানের কয়লা ব্যবহার করে। বায়ুদূষণ বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে একাধিক স্পঞ্জ আয়রন কারখানার কর্তাদের দাবি, তাঁরা উচ্চমানেরই কয়লা ব্যবহার করেন। তাঁদের দাবি, “সরকারের সব নির্দেশ মেনেই আমরা কারখানা চালাচ্ছি।”
|