কলকাতার পথঘাটে থুতু আর পান-গুটখার ‘আলপনা’ এখন সকলেরই প্রায় গা-সওয়া। যেখানে লেখা ‘এখানে থুতু ফেলা নিষেধ’, অবধারিত ভাবে তার চারপাশ ভরে রয়েছে থুতু আর পিকে। অবস্থা এখন এমনই যে, নিষেধাজ্ঞাটাও ঠিকঠাক পড়ার উপায় নেই।
রাস্তাঘাট, ফুটপাথ, সরকারি বহুতল, হাসপাতাল, পার্ক, শ্মশান যত্রতত্র থুতু ফেলাটাই যেন শহরবাসীর অভ্যাসের মধ্যে পড়ে। পরিস্থিতি এমনই গুরুতর যে, গুটখা ও পানমশলার পিকের আক্রমণে হাওড়া সেতুর স্তম্ভগুলি ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছে বলে সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় ধরা পড়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব তো রয়েছেই, পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছে, শহরকে সুন্দর রাখতে কলকাতা পুরসভা বা পুলিশ কতটা সচেতন, তা নিয়েও।
শহরের সৌন্দর্যায়নে বেশ কয়েক বছর ধরেই পুরসভার উদ্যোগে রাস্তার ডিভাইডারগুলিতে গাছ লাগানোর ব্যবস্থা হয়েছে। কংক্রিটের দেওয়াল তৈরি করে পোঁতা হয়েছে নানা ধরনের বাহারি গাছ। কিন্তু দিন কয়েক কাটতে না কাটতেই দেখা গিয়েছে, ওই রং করা দেওয়ালে পানের পিকের ছোপ ছোপ দাগ। পুরসভার তরফে ডিভাইডারগুলিতে নোটিস ঝোলানো হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি কিছুই। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় স্বীকার করেছেন, “নোটিস দিয়ে বা আইন প্রয়োগ করে জরিমানা আদায় করে এই বদ-অভ্যাস শোধরানো যাবে না।” কলকাতা পুলিশের ডি সি (ট্রাফিক) দিলীপকুমার আদকও মনে করেন, “জরিমানা ধার্য করে এ সব বন্ধ করা বেশ কঠিন।”
তা হলে কী ভাবে শোধরানো যাবে মানুষকে? দু’জনেরই বক্তব্য, এর জন্য দরকার জনতার সচেতনতা। কিন্তু কী ভাবে সেই সচেতনতা আসবে, সে ব্যাপারে ধারণা নেই পুলিশ বা পুরসভা কোনও পক্ষেরই। |
শিল্পী ও শিল্প। |
|
|
কলকাতার রাজপথে পরিচিত সেই দৃশ্য। |
পান-গুটখার হানায় বিবর্ণ হাওড়া সেতুর স্তম্ভ। |
—নিজস্ব চিত্র। |
|
শুধু কি দৃশ্য-দূষণ? চিকিৎসক মহলের বক্তব্য, এর থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর ভয়ও রয়েছে ষোলো আনা। ওষুধ-প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগীরা যত্রতত্র থুতু ফেললে তা থেকে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। পালমোনোলজিস্ট পার্থসারথি ভট্টাচার্য বলেন, “এখনও অনেকেই খালি পায়ে রাস্তায় হাঁটেন। বিশেষত ফুটপাথবাসী শিশুরা। কারও পায়ে কোনও ক্ষত থাকলে সেই খোলা ক্ষতে থুতু লেগে জীবাণু সংক্রমণ হতে পারে।”
মেডিসিন-এর চিকিৎসক মিলন চক্রবর্তীর কথায়, “কফের মধ্যে ফোমাইট নামে এক ধরনের পার্টিকল থাকে। তা থেকে ব্যাক্টেরিয়া ছড়ানোর ভয় থাকে। যক্ষ্মা রোগীদের ক্ষেত্রে ভয়টা আরও বেশি। থুতু ফেলার পরে এক মিনিট থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে তা থেকে ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণ হতে পারে। কফ ফেলার চেয়েও পাশে দাঁড়িয়ে যদি কেউ মুখে হাত চাপা না দিয়ে কাশেন এবং থুতু ফেলেন, তা হলেও তা থেকে বায়ুবাহিত হয়ে রোগ ছড়াতে পারে।” যাঁরা যত্রতত্র থুতু ফেলেন, হাঁচি-কাশির সময়ে মুখে হাত চাপা দেওয়ার সৌজন্যবোধ যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের থাকে না, তা আর কে না জানে!
কলকাতার রাস্তা যাঁরা অবলীলায় নোংরা করেন, তাঁরাই কিন্তু আবার বিদেশে গেলে অক্ষরে অক্ষরে নিয়ম মেনে চলেন। থুতু তো দূরের কথা, এক টুকরো কাগজও রাস্তায় ফেলার সাহস পান না তাঁদের অনেকেই। রাতারাতি কী ভাবে তৈরি হয় এই ‘সিভিক সেন্স’? প্রশাসনিক কর্তারা মনে করেন, শাস্তির ভয়ই এ ক্ষেত্রে তাঁদের নিয়ম মানতে বাধ্য করে।
কিন্তু রাস্তাঘাট এ ভাবে যথেচ্ছ নোংরা করা ঠেকাতে আইন তো এখানেও রয়েছে। তা হলে? প্রশ্ন হল, সেই আইন রূপায়ণ করবে কে? এ ব্যাপারে নজর রাখার দায়িত্ব কলকাতা পুলিশের। লালবাজারের এক কর্তা জানালেন, কলকাতা পুলিশ অ্যাক্টে থুতু ফেলা নিয়ে কোনও আইন না থাকলেও ‘ন্যুইস্যান্স অ্যাক্ট’ রয়েছে, যার মধ্যে থুতু ফেলার কথাও উল্লেখ রয়েছে। ওই ধারায় ধরা পড়লে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ২০০ টাকা জরিমানা দিতে হয়। তবে সাম্প্রতিক কালে থুতু ফেলার জন্য কোনও জরিমানা ধার্য করার কথা তাঁদের জানা নেই বলেই জানালেন লালবাজারের কর্তারা।
ভারতীয় রেলের আইনেও থুতু ফেলা দণ্ডনীয় অপরাধ। প্ল্যাটফর্মে, স্টেশন চত্বরে বা ট্রেনের ভিতরে থুতু ফেললে জরিমানার পরিমাণ ৫০০ টাকা। এমনকী, ছ’মাস জেলও হতে পারে। কিন্তু শুধু থুতু ফেলা নয়, তার সঙ্গে রয়েছে প্রকাশ্যে মল-মূত্রত্যাগ, স্নান বা রান্না করা ও মদের বোতল ফেলার মতো অপরাধও। শুধু থুতু ফেলার জন্য কত জনকে জরিমানা করা হয়েছে, তার কোনও হিসেব রেল-কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। একই অবস্থা মেট্রো রেলের। মেট্রোর জনসংযোগ আধিকারিক প্রত্যুষ ঘোষ বলেন, “থুতু ফেলা বা প্ল্যাটফর্ম নোংরা করার অভিযোগে গত এক বছরে বেশ কয়েক লক্ষ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। তবে, শুধু থুতু ফেলার জন্য কত টাকা আদায় হয়েছে, আলাদা করে তার হিসেব নেই।”
আসলে এই বিষয়টাকে একটা গুরুতর সমস্যা বলে ভাবার মতো মানসিকতাই এখনও তৈরি হয়নি। প্রতিনিয়ত তারই মাসুল গুনছে আমাদের এই শহর।
|