হরিণঘাটার সাধনা ‘মা’ নন! নমুনা রিপোর্টে বিধ্বস্ত সোনা
ক ঝটকায় চোখের সামনে নেমে এল নিকষ অন্ধকার! ধসে পড়ল ৩৬ দিন ধরে গড়ে তোলা স্বপ্নের ইমারত!
সুইত্‌জারল্যান্ডের সোনা মুথুলিঙ্গম-এর সঙ্গে হরিণঘাটায় খুঁজে পাওয়া তাঁর ‘মা’ সাধনা দেবনাথ-এর ডিএনএ নমুনা মিলল না। আর তাতেই মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছেন সোনা। তবে লড়াই ছাড়তে নারাজ তিন সন্তানের জননী, ৩২ বছরের এই যুবতী। তাঁকে ছোটবেলায় ‘অপহরণ’ করা হয়েছে বলে এ বার সরাসরি কলকাতা পুলিশের কাছে অভিযোগ করলেন সোনা।
আর মা? যিনি ক’দিন আগেও বলেছিলেন, জুরিখের সোনা-ই তাঁর হারিয়ে যাওয়া মেয়ে! এ দিন আনন্দবাজারের কাছে খবরটা শুনে যেন বিশ্বাসই করতে চাইছিলেন না। দু’দিন আগেই মেয়ে কুসুমকে বলেছিলেন, “একটা ফোন করে দেখ না, কোনও খবর এল কি না!” মঙ্গলবার রাতে কুসুমের ফোনে যোগাযোগ করা হলে খবরটা পেয়ে যেন ডুকরে উঠলেন সাধনাদেবী। “মেলেনি! সেকি? এ কী করে সম্ভব? রক্তের টান বলেও তো একটা কথা আছে! আপনি যা-ই বলুন না কেন, মন বলছে, সোনা-ই আমার মেয়ে।”
এ শহর থেকে কয়েকশো যোজন দূরে বসেই দীর্ঘ এক যুগ ধরে সোনা নিরন্তর খোঁজ চালিয়ে গিয়েছেন কলকাতা বা তার আশেপাশে কোথাও লুকিয়ে থাকা মায়ের। অবশেষে ১২ বছর পরে, গত ১০ অগস্ট জানতে পেরেছিলেন হরিণঘাটার ওই মহিলার কথা। আনন্দবাজারে প্রকাশিত খবর পড়েই এগিয়ে এসেছিলেন সাধনাদেবী। দাবি করেছিলেন, সোনা তাঁরই মেয়ে। দু’জনের লালার নমুনা পাঠানো হয়েছিল নেদারল্যান্ডসের এক পরীক্ষাগারে। কিন্তু পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হতে জানা গেল, সেই দাবি ঠিক নয়!
প্রশ্ন উঠেছে, নেদারল্যান্ডসের এই ডিএনএ পরীক্ষা কি একশো শতাংশ নির্ভুল?
হায়দরাবাদের সেন্টার ফর সেলুলার অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োলজি-র জিন বিশেষজ্ঞ উত্‌পল ভদ্র-র কথায়, “লালা-র নমুনা নিলে তার সঙ্গে ব্যাক্টেরিয়া থাকতেও পারে। সে ক্ষেত্রে সংক্রমণ হতে পারে এবং ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট নির্ভুল না-ও হতে পারে।” রক্তের নমুনা পরীক্ষা করাই এ ক্ষেত্রে নির্ভুল বলে মনে করেন তিনি।
কিন্তু সোনা নিজে কী ভাবছেন? তিনি কি দ্বিতীয় বার পরীক্ষা করাতে রাজি? সোনার বক্তব্য, কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁর কলকাতায় আসার কথা ছিল। কিন্তু ডিএনএ পরীক্ষার ফল না মেলায় আপাতত কলকাতায় আসবেন না। তা হলে দ্বিতীয় বার পরীক্ষার কী হবে? সোনার আশা, কলকাতা পুলিশ তাঁর অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করে হোমের থেকে কাগজপত্র জোগাড় করতে পারবে। সেই সব কাগজপত্র থেকেও যদি ইঙ্গিত মেলে যে, সাধনাই সোনার মা, তা হলেই দ্বিতীয় বার ডিএনএ পরীক্ষা করাবেন তিনি। কিন্তু সেই পরীক্ষা ভারতে করাতে নারাজ তিনি। সোনার কথায়, “পুলিশের মধ্যস্থতায় আমাকে সাধনাদেবীর রক্তের নমুনা পাঠালে আমি জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে তা পরীক্ষা করাতে পারি। কিন্তু, তা পাঠাতে হবে সুইস দূতাবাস মারফত।”
১৯৮১ সালে কলকাতার একটি হোম থেকে সোনাকে দত্তক নিয়ে সুইত্‌জারল্যান্ডে যান মুরান্ডি দম্পতি। সেই দেশের নাগরিক হিসেবে বেড়ে ওঠেন তিনি। ২০০০ সালে শ্রীলঙ্কার এক যুবককে বিয়ে করেন। ২০০১ সালে জন্ম নেয় প্রথম পুত্র সন্তান। তার পরেই নিজের জন্মদাত্রী মাকে খুঁজতে শুরু করেন সোনা। সেই বছরেই স্বামীকে নিয়ে হারানো মায়ের খোঁজে চলে আসেন কলকাতায়। হোমের কেউ তাঁর জন্মদাত্রী মায়ের খোঁজ দিতে পারেননি। শুধু বাংলায় লেখা একটি চিঠি তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়।
মাকে খুঁজে না পেয়ে লালবাজারে পুলিশের কাছে অভিযোগ জমা দিয়ে হোমের সেই চিঠি নিয়ে নিজের দেশে ফিরে যান সোনা। এর মধ্যেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় জার্মানির যুবক অরুণ ডোল এবং পুণের অঞ্জলি পওয়ারের। অরুণ এবং অঞ্জলি শিশু-পাচারের বিরুদ্ধে সমাজ সচেতনতার কাজ করেন। সোনার হয়ে তাঁর মাকে খুঁজতে কলকাতায় আসেন অরুণ-অঞ্জলি।
৫ অগস্ট আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয় সোনা-র ঘটনা। তাঁকে হোমে ফেলে যাওয়া মহিলার সেই আর্তি-মাখানো চিঠিও ছাপা হয়। যেখানে লেখা ছিল, ‘ভিক্ষা করে আমার দিন চলে। স্বামী দশ মাস আগে নিখোঁজ। এই মেয়েকে আমি মানুষ করতে পারবো না। এই মেয়ের দায়িত্ব হোমের হাতে তুলে দিলাম।’ তার ক’দিন পরেই, গত ১০ অগস্ট হরিণঘাটার মেদেরমাঠ-পূর্বপাড়া এলাকা থেকে খোঁজ মেলে সোনার ‘মা’ সাধনাদেবীর।
সে দিনই জুরিখ থেকে সোনা ফোনে কথা বলেন সাধনাদেবীর সঙ্গে। তাঁকে ‘মা’ বলে সম্বোধনও করেন। পরে ই-মেলে পাঠানো সাধনাদেবীর ছবি দেখে সোনা ফোনে বলেন, “ছবি দেখে মনে হচ্ছে, আমার সঙ্গে চেহারার মিলও রয়েছে।” সাধনাদেবীই যে তাঁর হারিয়ে ফেলা মা, তা এক রকম বিশ্বাসই করতে শুরু করে দিয়েছিলেন তিনি। রবিবার, সেই বিশ্বাসটাই ভেঙে পড়ল হুড়মুড়িয়ে। এ বার কী করবেন?
ফোনের ও প্রান্ত থেকে ধরা গলায় সোনা বলেন, “ভেবেছিলাম, কলকাতা যাবো। মনে মনে উত্তেজিত ছিলাম। কিন্তু কী হবে কলকাতায় গিয়ে? যাঁকে এক মাস ধরে মা বলে ভাবছিলাম, তিনি আমার মা কি না, সেটা নিয়েই সংশয়!” কিন্তু আপনিও তো বলেছিলেন আপনার সঙ্গে মিল রয়েছে সাধনাদেবীর? এর কোনও জবাব নেই সোনা-র কাছে। সোনা-র দুই বন্ধু অরুণ এবং অঞ্জলি বলেন, “আমাদেরও মনে হয়েছিল সোনা-র সঙ্গে চেহারার মিল রয়েছে সাধনাদেবীর। এমনকী সাধনাদেবীর মেয়ে কুসুমের সঙ্গেও মিল রয়েছে সোনা-র।”
তবে হাল ছাড়তে নারাজ সোনা। ই-মেল মারফত কলকাতা পুলিশের কাছে অভিযোগে তিনি লিখেছেন, “সাধনা যদি আমার মা না হন, তা হলে ধরে নিতে হবে, যে চিঠি আমাকে ২০০১ সালে কলকাতার হোম থেকে দেওয়া হয়েছিল, তা মিথ্যা। ধরে নিতে হবে, আমার মা নিজে থেকে আমাকে হোমে তুলে দেননি। তবে কি আমাকে অপহরণ করে হোমে বিক্রি করা হয়েছে?” তাঁর অভিযোগ, যে হোম থেকে তাঁকে দত্তক নেওয়া হয়েছিল, সেই টেরেডাস হোম-এর কর্তারা পুরো বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কিন্তু তাঁরা বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলছেন না।
সোনা-র কাছে যে চিঠি রয়েছে, তাতে তাঁর মা হিসেবে কমলা নাথ বলে এক মহিলার নাম লেখা। সাধনাদেবী তাঁর ছোট মেয়েকে তুলে দিয়েছিলেন দিদি কমলা-র হাতে। কমলা দেবনাথ স্বীকার করেছেন, তিনি দক্ষিণ কলকাতার একটি হোমে গিয়ে তুলে দেন সেই মেয়েকে। সোনা-কে দত্তক নেওয়া বা কমলা নাথের হোমে আসার সময়টুকুও মিলছে। পারিপার্শ্বিক তথ্য-প্রমাণ দেখে সোনারও মনে হয়, সাধনাদেবীই তাঁর হারানো মা। কিন্তু পরীক্ষা তো অন্য কথা বলছে! তবে কি সাধনাদেবীর দাবি মিথ্যা?
সোনা কিন্তু উল্টো কথাই বলেছেন। তাঁর দাবি, “সাধনাদেবীর মেয়ে হয়তো অন্য কোথাও রয়েছেন। আমার মা-ও অন্য কোথাও রয়েছেন। একই সময়ে একই হোমে ঘটনাটি ঘটেছে। ওই টেরেডাস হোম থেকে যদি সঠিক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়, তা হলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। জানা যাবে সাধনাদেবীর আসল মেয়ে কে? তাই পুলিশের দ্বারস্থ হচ্ছি।”

পুরনো খবর
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.