মোবাইল বেয়ে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে ভেসে আসা ‘মা’ ডাক শুনেই কেঁপে গেল বৃদ্ধার গলা। কেঁদে উঠলেন, “এক বার ফিরে আয় মা। এক বার তোকে দু’চোখ ভরে দেখব। আর কিচ্ছু চাই না।” আর ওইটুকু সময়েই ফোনে বন্ধুর কাছ থেকে শিখে নেওয়া ভাঙা বাংলায় সুইৎজারল্যান্ড থেকে মেয়ে বললেন, “হ্যাঁ, মা। আমি আসব।”
মা-মেয়ের ৩২ বছরের বিচ্ছেদের অবসান হল কি না, সেটা অবশ্য সময়ই বলবে। কারণ, হরিণঘাটার সাধনা দেবনাথই জুরিখের সোনা মুথুলিঙ্গমের মা কি না, ডিএনএ পরীক্ষার পরেই সেটা নিশ্চিত ভাবে বোঝা যাবে। সে জন্য সাধনাদেবীর লালার নমুনা যাচ্ছে সুইৎজারল্যান্ডে। সেই লালার ডিএনএ সোনার ডিএনএ-র সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে। ১৯৮১ সালে কলকাতার একটি হোমের কর্তাদের হাতে চার মাসের সোনাকে যিনি তুলে দিয়েছিলেন, তাঁর নাম অবশ্য সাধনা নয়, কমলা নাথ। চিঠি লিখে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘ভিক্ষে করে আমার দিন চলে। স্বামী নিরুদ্দেশ। এই মেয়েকে আমি মানুষ করতে পারব না। তাই ওর দায়িত্ব হোমের হাতে তুলে দিলাম।’ সেই হোম থেকে সেই বছরেই সোনাকে দত্তক নেন সুইৎজারল্যান্ডের মুরান্ডি দম্পতি। পালক মা ঘর ছাড়ার পরে বোর্ডিং স্কুলে বড় হয়েছেন সোনা। বিয়ে করেছেন শ্রীলঙ্কার ছেলে যশোধরন মুথুলিঙ্গমকে।
|
২০০১ সালে ছেলের জন্মের পর আসল মায়ের জন্য মন কেমন করাটা বেড়ে যায় সোনার। পরের বছরই কলকাতায় এসে যোগাযোগ করেন সেই হোমের সঙ্গে। কিন্তু কমলার লেখা চিঠি আর নিজের চার মাস বয়সের একটা ছবি ছাড়া আর কিছুই পাননি। কিন্তু কমলা সাধনা হয়ে গেলেন কী ভাবে?
কাহিনিটা চমকপ্রদ।
সোনাকে নিয়ে গত ৫ অগস্ট প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার পত্রিকায়। শনিবার সকালে নদিয়ার মেদেরমাঠ-পূর্বপাড়া থেকে বিপিন আচার্য নামে এক ব্যক্তি ফোন করেন এই প্রতিবেদককে। জানান, ৫ তারিখ প্রকাশিত সোনার ছবি দেখে সাধনা দেবনাথ নামে এক বৃদ্ধার তা চেনা-চেনা ঠেকছে। তিনি বলেছেন, ৩২ বছর আগে তিনি তাঁর মেয়েকে দিদির হাতে তুলে দিয়েছিলেন। দিদির নাম কমলা নাথ। দু’দিন আগে সাধনাদেবীর জা-ও নাকি এসে আনন্দবাজার দেখিয়ে বলেন, “হ্যাঁ রে, এটাই তোর ছোট্ট মেয়েটা না!”
কানাগলির শেষে আবর্জনার স্তূপের পাশে, বস্তির মধ্যে সাধনাদেবীর একচিলতে ঘর। বিধবার দিন কাটে লোকের বাড়ি কাজ করে। তিনি জানালেন, এক ছেলে, দুই মেয়ের পর তাঁর কোলে এসেছিল সোনা। কাষ্ঠডাঙা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তার জন্মের একুশ দিনের মাথায় সাধনাদেবীর স্বামী মারা যান। তার পর থেকেই শুরু হয় বাড়িতে অশান্তি। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বলেন, ‘এ মেয়ে বাবাকে খেয়েছে। একে বাড়িতে রাখতে দেব না।’ সাধনাদেবীর কথায়, “স্বামী হারিয়ে তখন আমারও পাগলের মতো অবস্থা। বাধ্য হয়ে ব্যারাকপুরে দিদির বাড়িতে রেখে এলাম ওকে। মাস দেড়েক পর দিদির বাড়িতে গিয়ে শুনলাম, সোনা মারা গিয়েছে!”
তা হলে সে হোমে ঠাঁই পেল কী করে? সোনার ঠিক উপরের দিদি কুসুম বললেন, “বড় হয়ে মাসির কাছে শুনেছিলাম, সোনাকে একটা হোমে দেওয়া হয়েছিল।”
ধোঁয়াশা কাটাতে কুসুম আর সাধনাদেবীকে নিয়ে যাওয়া হল ব্যারাকপুরে কমলাদেবীর বাড়িতে। সব শুনে স্বীকার করলেন, সোনাকে হোমে দিয়েছিলেন তিনিই। বললেন, “তখন কলকাতায় কাজ করি। অতটুকু একটা মেয়েকে কী ভাবে রাখব? তাই মৌলালির কাছে একটা হোমে দিয়েছিলাম।” বোন জানতে পারলে মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করবেন বলে সে কথা তাঁকে বলেননি। |
কলকাতা থেকে ফিরে যাওয়ার পরেও মায়ের খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন সোনা। এই সময়েই ইন্টারনেটে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয় দু’জনের অঞ্জলি পওয়ার এবং অরুণ ডোল। দত্তকের নাম করে শিশু পাচারের বিরুদ্ধে কাজ করছেন এই দুই যুবক-যুবতী। এর আগে ৩১ জন দত্তক সন্তানকে জন্মদাত্রীর কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। জার্মানির বাসিন্দা অরুণ নিজেও এক দত্তক-পুত্র। আর অঞ্জলি থাকেন পুণেতে। সোনার মায়ের খোঁজে আপাতত তাঁরা কলকাতায়।
এ দিন বিপিনবাবুর ফোনের কথা জেনেই পত্রপাঠ হরিণঘাটা রওনা হন অরুণ-অঞ্জলি। যেতে যেতেই ফোনে সব জানানো হয় সোনাকে। হরিণঘাটা পৌঁছে প্রথমে সোনার দিদি কুসুমকে দেখেই অনেকটা আশ্বস্ত হন তাঁরা। অঞ্জলি বলেন, “কুসুমের সঙ্গে সোনার মুখের মিল রয়েছে।... জানেন, আমরা কাল সকালেই ফিরে যেতাম। তার পর সোনা হয়তো খোঁজ বন্ধ করে দিতেন।”
তবে মা-মেয়ে সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হতেই ডিএনএ পরীক্ষাটা করাতে চাইছেন অঞ্জলিরা। আর সাধনাদেবী বলছেন, “সব কিছুই তো মিলে যাচ্ছে। এর পরেও কারও সন্দেহ থাকলে আমি যে কোনও পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত। শুধু এক বার মেয়েকে দেখতে চাই।”
সুইৎজারল্যান্ডে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা যখন পাঠানো হবে, তখন তার সঙ্গে সাধনাদেবীর একটা ছবিও চেয়েছেন সোনা। অঞ্জলিই মোবাইলে ধরলেন তাঁকে। দিলেন সাধনাদেবীকে। সোনা বাংলা জানেন না, কিন্তু কী এসে গেল তাতে? ভেঙে গেল দেশ-কাল-ভাষার গণ্ডি। রবিবার ভোরের আলো ফোটার আগেই তোতাপাখি খোঁজ এনে দিল মায়ের। দারুণ উত্তেজিত সোনা বললেন, “ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কলকাতায় যাওয়ার চেষ্টা করব।” |