মহাকরণ ছাড়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিল সরকার। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই সব দফতরকে মহাকরণ ছেড়ে অন্যত্র উঠে যেতে হবে বলে শনিবার বিভিন্ন দফতরের সচিবদের জানিয়ে দিয়েছেন মুখ্যসচিব। কিন্তু যে কারণে এই স্থানবদল, সেই মহাকরণ সংস্কারের কাজ কোন পথে এগোবে, কোন সংস্থাকেই বা সংস্কারের ভার দেওয়া হবে, তার কোনও রূপরেখা এখনও তৈরি করে উঠতে পারেনি সরকার।
মহাকরণে এখন যে দফতরগুলি রয়েছে, সেগুলির সচিবদের নিয়ে শনিবার বৈঠক করেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র। সেই বৈঠকে তিনি বলেন, বিভাগীয় সচিবদেরই দায়িত্ব নিয়ে নিজের নিজের দফতরকে মহাকরণের বাইরে নিয়ে যেতে হবে। দফতরগুলি সরানোর কাজ তদারকের জন্য ভূমিসচিব অমরেন্দ্রকুমার সিংহের নেতৃত্বে একটি কমিটি গড়ে দিয়েছেন তিনি। আর হাওড়ার এইচআরবিসি ভবনে দফতরগুলির বসার সুষ্ঠু বন্দোবস্তের বিষয়টি তদারকের জন্য সংস্থার ভাইস-চেয়ারম্যান সাধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আরও একটি কমিটি গড়া হয়েছে। মহাকরণের সব দফতরকেই অবশ্য হাওড়ায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, স্থানাভাব। সরকারি সূত্রের খবর, মহাকরণে জায়গা মোট সাড়ে চার লক্ষ বর্গফুট। কিন্তু এইচআরবিসি ভবনে জায়গা রয়েছে মোট দেড় লক্ষ বর্গফুট। তাই বাছাই করা ১১টি দফতর আপাতত গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে স্থানান্তরিত হবে। সেগুলি হল মুখ্যমন্ত্রীর অফিস, স্বরাষ্ট্র দফতর, কর্মিবর্গ ও প্রশাসনিক সংস্কার দফতর, পার্বত্য বিষয়ক, সংখ্যালঘু উন্নয়ন, তথ্য ও সংস্কৃতি, ভূমি ও ভূমি সংস্কার, অর্থ, আইন ও বিচার, বিপর্যয় মোকাবিলা এবং রাজ্য পুলিশ প্রধানের দফতর। |
অন্য দফতরগুলিও সেপ্টেম্বরের মধ্যেই মহাকরণ ছাড়বে। তবে তারা কলকাতার মধ্যেই নিজস্ব ভবনে উঠে যাবে। তবে হাওড়ায় ১১টি দফতরের জায়গা পাওয়া নিয়েও সমস্যা হতে পারে বলে সরকারি সূত্রের খবর। সে জন্য দফতরগুলির কোন কোন বিভাগকে হাওড়ায় আগে নিয়ে যাওয়া হবে, সচিবদেরই তা ঠিক করতে বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে হয়তো আপাতত কোনও দফতরের ৭৫ ভাগ হাওড়ায় সরানো হল। পরে মহাকরণ থেকে সরানো হতে পারে তার বাকি অংশ। পূর্ত দফতরের এক কর্তা জানান, মহাকরণ অর্ধেক খালি হলেই সংস্কারের কাজ শুরু করে দেওয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কোনও কোনও দফতর আংশিক ভাবে মহাকরণে কিছু দিন রয়ে গেলেও আপত্তি নেই। তবে যে সব দফতরের বাড়ি তৈরি হয়ে গিয়েছে, তাদের অবশ্যই ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মহাকরণ ছেড়ে চলে যেতে হবে।
মন্ত্রীরা কোথায় বসবেন? পূর্ত দফতরের কর্তারা জানান, এই ব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার, মুখ্যমন্ত্রীই নেবেন। মন্ত্রীরা চাইলে কিছু দিন মহাকরণে বসতে পারেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী নিজে ১ অক্টোবর থেকে বসবেন হাওড়ার ওই ১৪ তলা ভবনে। সেখানে ১৪ তলাতেই তাঁর পূর্বমুখী অফিস তৈরি হচ্ছে। এ পর্যন্ত ঠিক আছে, শুধুমাত্র মুখ্যসচিবের অফিস থাকবে ওই তলায়।
কিন্তু মহাকরণ সংস্কারের কী হবে? বিশিষ্ট স্থপতি এবং বাস্তুকাররা আগেই বলেছেন, রাইটার্স বিল্ডিংয়ের মতো ২৩৭ বছরের পুরনো ভবনের সংস্কারের ক্ষেত্রে দু’টি বিষয় নজরে রাখা জরুরি। প্রথমত, গথিক স্থাপত্যরীতির মূল বিষয়গুলি অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, সচিবালয় হিসেবে কাজকর্ম চালানোর জন্য আধুনিক পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। আর সেই কারণেই পূর্ব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোনও বিশেষজ্ঞ সংস্থাকেই এই কাজের ভার দেওয়ার পক্ষপাতী তাঁরা। কিন্তু পূর্ত দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, আপাতত শুধু মহাকরণ থেকে দফতরগুলি সরানোর ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত হয়েছে। তার পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিবপুরের বেসু-র স্থপতিবিদ্যার প্রধানদের পরামর্শ নিয়ে সংস্কার সংক্রান্ত পরবর্তী পদক্ষেপ স্থির করার কথা। প্রয়োজনে পেশাদার সংস্থার সাহায্যও নেওয়া হতে পারে। তবে কিছুই চূড়ান্ত হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, রাইটার্স বিল্ডিংয়ের মতো ঐতিহ্যবাহী ভবনের সংস্কার করার পেশাদারিত্ব আদৌ নেই রাজ্যের পূর্ত দফতরের। দিল্লির বিভিন্ন প্রাচীন ভবনের সংস্কারের ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় পূর্ত মন্ত্রক কোনও কাজ করে না। পুরনো নকশা ও ছবির ওপর ভিত্তি করে পেশাদার বিশেষজ্ঞ স্থপতিদের সাহায্যেই সেই কাজ করা হয়। কলকাতায় রাজভবনের সংরক্ষণ এবং সংস্কারের জন্য রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন মুম্বইয়ের এক সংস্থাকে নিয়োগ করেছেন। ভারতীয় জাদুঘরের সংস্কারের কাজ তদারক করছে এক ব্রিটিশ সংস্থা। কিন্তু মহাকরণ সংস্কারের খুঁটিনাটি নিয়ে কী ভাবা হচ্ছে, তার সদুত্তর এখনও নেই। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, তাঁরা ঠাঁইবদল করছেন মাত্র ছ’মাসের জন্য। স্বভাবতই এই স্বল্প সময়ে সুবিশাল মহাকরণের কতটা ভোলবদল হবে, তা নিয়ে কৌতূহল রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, সংস্কারের সময়সীমা বেঁধে না দিয়ে তার গুণগত মানটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত। দেখা উচিত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই সাহসী পদক্ষেপ যেন স্রেফ পরিকল্পনার অভাবে মাঠে মারা না যায়। |