পেশাদার হাতে না দিলে সংস্কারেও বিপর্যয়ের ভয়
ড়াইশো বছরের পুরনো রাইটার্স বিল্ডিং যে দিনেকালে জতুগৃহে পরিণত হয়েছে, সেটা অনেক দিনই জানা। মাঝেমধ্যে ছোটখাটো দুর্ঘটনা যখন আরও বড় বিপর্যয়ের অশনিসঙ্কেত বহন করে এনেছে, তখন নড়েচড়ে বসেছে সরকার। চর্চা হয়েছে মহাকরণের আমূল সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। কিন্তু কাজের কাজটা আর হয়ে ওঠেনি। শেষ পর্যন্ত ঘণ্টাটা বেঁধেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জানিয়ে দিয়েছেন, ছ’মাসের জন্য রাজ্যের সচিবালয় গঙ্গাপারে এইচআরবিসি-র বাড়িতে পাঠিয়ে সারানো হবে মহাকরণ।
কিন্তু সেই সংস্কারের রূপরেখা কী, বড় প্রশ্ন সেটাই। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, মহাকরণ সংস্কারের দু’টি দিক রয়েছে। একটি, তার ঐতিহ্য বজায় রাখা। অন্যটি, তাকে আধুনিক প্রশাসন চালানোর উপযুক্ত করে গড়ে তোলা। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে সংসদ ভবন, হায়দরাবাদ হাউস দিল্লিতে ব্রিটিশ আমলের বহু বাড়ি সংস্কারের গুরুদায়িত্ব সামলানো সুনীতা কোহলির কথায়, “দু’টি দিক মাথায় রেখে এগোতে হবে। প্রথমত, ঐতিহাসিক স্থাপত্যরীতির মূল বিষয়গুলি অপরিবর্তিত রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, ওই ভবনে এখনকার কাজ চালানোর জন্য কী কী ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন, তা দেখতে হবে।” এবং দুই কাজই চূড়ান্ত পেশাদার হাতে হওয়া উচিত বলে জানান সংস্কার কাজের বিশেষজ্ঞরা।
মহাকরণ সংস্কার নিয়ে সরকারি ভাবনাচিন্তা অবশ্য এখনও স্পষ্ট নয়। সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, এ ব্যাপারে মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটিতে রয়েছেন স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিবহণসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্তসচিব ইন্দিবর পাণ্ডে এবং অর্থসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী। কমিটির সদস্যরা কয়েক বার ঘরোয়া আলোচনায় মহাকরণকে তার মূল চেহারায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেও সংস্কারের পরিকল্পনা ছকার কাজ এখনও শুরু হয়নি। তবে দেশের অন্যত্র এই ধরনের ঐতিহ্যবাহী ভবনের সংস্কারের কাজ যে ভাবে হয়, সেটা এই কমিটি উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করতেই পারে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। তাদের মতে, সরকারি নিয়মনীতির নিগড়ে আটকে সংস্কারের কাজ করতে গেলে কাঙ্ক্ষিত ফল তো পাওয়া যাবেই না, উল্টে বিপর্যয়ের আশঙ্কা থেকে যাবে। যথেষ্ট দক্ষতাহীন সরকারি সংস্থাকে দিয়ে কাজ করানোর ফলে যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল উল্টোডাঙা উড়ালপুলে।
সংস্কার কাজে পেশাদারের দ্বারস্থ হওয়ার উদাহরণ অবশ্য এই রাজ্যেই রয়েছে। যেমন রাজভবন। ঐতিহ্যবাহী এই ভবন সংস্কারের পরিকল্পনা শুরু হয়েছে গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে। সে জন্য প্রাথমিক ভাবে এ রাজ্যের বিশেষজ্ঞ স্থপতিদের নিয়ে একটি কমিটি গড়ে দেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন। সেই কমিটির তত্ত্বাবধানে এই ধরনের সংস্কারের কাজে দক্ষ সংস্থাগুলির কাছ থেকে আগ্রহপত্র (এক্সপ্রেশন অফ ইন্টারেস্ট) চাওয়া হয়। আগ্রহী সংস্থাগুলির মধ্যে থেকে তিনটিকে বাছাই করে তাদের রাজভবনে আসতে বলা হয়।
মেরামতির মন্ত্র

অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে মূল স্থাপত্যরীতি
জায়গা দিতে হবে আধুনিক পরিকাঠামোকে
মাথায় রাখতে হবে ইতিহাস, শহরের চরিত্রও
চাই পুরনো মানচিত্র, নথি, ছবি
প্রয়োজন পুরোদস্তুর গবেষণা
দায়িত্ব দিতে হবে পেশাদার সংস্থাকে
সুনীতা কোহলি


অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, পুরোপুরি গবেষণার
উপর ভিত্তি করে খুব সাবধানে এগোতে হবে।
গোটা বাড়ি ঘুরে দেখে তারা আলাদা আলাদা রিপোর্ট জমা দেয়। সংস্কার পরিকল্পনা নিয়ে রাজ্যপালের সামনে ‘পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন’-ও দেয় তারা। তার পরে সব দিক বিচার করে মুম্বইয়ের একটি পেশাদার স্থপতি সংস্থাকে রাজভবনের সংস্কারের ভার তুলে দিয়েছেন রাজ্যপাল। ওই সংস্থা এর আগে মুম্বইয়ের ছত্রপতি শিবাজী মিউজিয়ামের সংস্কার করেছে।
দু’শো বছরে পা-দেওয়া ভারতীয় জাদুঘরের সংস্কারের কাজ তদারকিতেও ডাকা হয়েছে এক ব্রিটিশ সংস্থাকে। এই কাজের মূল বরাত পাওয়া ন্যাশনাল বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানির (এনবিসিসি) এক কর্তার কথায়, “ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতি মেনেই জাদুঘর তৈরি হয়েছিল। সেই কারণে তার সংরক্ষণ ও সংস্কারের কাজ তদারক করতে ব্রিটিশ সংস্থাকে ডাকা হয়েছে। যাদের এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আছে।”
ফলে মহাকরণের সংস্কারের কাজ সরকারি নিয়ম মেনে পূর্ত দফতরের হাতে ছেড়ে দেওয়াটা উচিত হবে না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আইআইটি খড়গপুরের অধ্যাপিকা এবং কলকাতার প্রিন্সেপ ঘাটের সংস্কারের দায়িত্বে থাকা সঙ্ঘমিত্রা বসুর মতে, “এই ধরনের ভবন সংস্কার শুরু করার আগে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করা প্রয়োজন। তাতে অবশ্যই এ কাজে অভিজ্ঞ এক জন স্থপতি এবং অভিজ্ঞ এক জন বাস্তুকারকে রাখতে হবে। এই কমিটিই ঠিক করে দেবে, ভবনটির ঐতিহাসিক বাস্তুচরিত্র অক্ষু্ণ্ণ রেখে কী ভাবে সংস্কারের কাজ এগোবে।” টাউন হলের সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত স্থপতি পার্থ দাসের বক্তব্য, “ঐতিহ্যশালী ভবনের সংস্কারের অভিজ্ঞতা রয়েছে, এমন সংস্থা বা ব্যক্তিই এ ধরনের কাজ ঠিকমতো করতে পারবে।”
অভিজ্ঞতাকে কেন এত গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা? এর কারণ হিসেবে উদাহরণ দিয়ে তাঁরা বলছেন, রাইটার্স বিল্ডিংয়ে মূল সিঁড়িটা কাঠ দিয়ে তৈরি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা এক দিকে যেমন জীর্ণ হয়েছে, তেমনই যত লোক প্রতিদিন এই সিঁড়ি ব্যবহার করবে ভাবা হয়েছিল, তার থেকে অনেক বেশি লোক এখন তা ব্যবহার করেন। অথচ, ঐতিহ্য বজায় রাখতে গেলে এই কাঠের সিঁড়িটাই রেখে দিতে হবে। সে জন্য বহিরঙ্গটা বজায় রেখে ভেতর থেকে তাকে মজবুত করতে হবে। এই ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা না-থাকলে সাধারণ কোনও ইঞ্জিনিয়ারের পক্ষে যার দিশা পাওয়া সম্ভব নয়।
ঐতিহ্যবাহী ভবনের কাজে অন্য চ্যালেঞ্জের কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সুনীতাদেবীর কথায়, “অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমস্ত পুরনো নকশা, পরিকল্পনা বা কাঠামো সংক্রান্ত নথি মেলে না। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, পুরোপুরি গবেষণার উপর ভিত্তি করেখুব সাবধানে এগোতে হবে।” সংঘমিত্রাদেবীও বলছেন, “প্রথমেই জোগাড় করতে হবে যাবতীয় নির্মাণ নকশা ও বিভিন্ন সময়ের ছবি। বিশেষজ্ঞেরা তারই ভিত্তিতে তৈরি করবেন সংস্কারের পরিকল্পনা। এ ধরনের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সংস্কারের কাজ না এগোলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।” পূর্ত দফতরের অবশ্য দাবি, ১৮০০ সাল থেকে মহাকরণের যাবতীয় নকশা তাদের হাতে রয়েছে।
এ তো গেল ঐতিহ্য বজায় রাখার দিক। কিন্তু রাজ্যের সচিবালয় চালানোর জন্য এখন যে আধুনিক পরিকাঠামো দরকার, তার কী হবে?
বিশ্বমানের প্রশাসনিক পরিকাঠামো ব্যবস্থার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁদের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয় দিয়েই এই পর্যায়ের সংস্কারের কাজ শুরু করা দরকার। মহাকরণে এখন যে জায়গায় মুখ্যমন্ত্রীর দফতর রয়েছে, সেটা মোটেই উপযুক্ত নয় বলেই তাঁদের মত। ওই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের ঘর হওয়া উচিত বাড়ির এককোণে, খোলামেলা পরিবেশে। এই কোণটা দক্ষিণ-পূর্ব হলে সবচেয়ে ভাল। কারণ তাতে আলো-বাতাস দুইই মিলবে পর্যাপ্ত। তা ছাড়া, ঘরটা বাড়ির সর্বোচ্চ তলে হওয়া বাঞ্ছনীয় বলেই তাঁদের মত। তিন তলা মহাকরণে এখন মুখ্যমন্ত্রীর ঘর রয়েছে দোতলায়।
মুখ্যমন্ত্রীর দফতরকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তোলার উপরেও জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের বক্তব্য, দেশ-বিদেশ থেকে নানা বিশিষ্ট অতিথি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আসেন। তাঁদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য আন্তর্জাতিক মানের কক্ষ থাকতে হবে। সম্মেলন কক্ষে রাখতে হবে ভিডিও কনফারেন্স থেকে শুরু করে আধুনিক যোগাযোগের যাবতীয় ব্যবস্থা। যাতে মুখ্যমন্ত্রীকে কোনও কিছুর জন্যই অন্যত্র দৌড়তে না হয়। গোটা সচিবালয়ের আবহটাই হতে হবে বিশ্বমানের, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
এইচআরবিসি ভবনে যাওয়ার দিন ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। জানিয়েছেন ফিরে আসার সময়টাও। ছ’মাসের মধ্যে মহাকরণে ফিরে আসার ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত অনড় তিনি। কিন্তু তার মধ্যে কি সেরে ফেলা সম্ভব এত বড় সংস্কারের কাজ? সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, সংস্কারের গুরুত্ব এবং বাস্তবতা যদি মুখ্যমন্ত্রী বোঝেন, তা হলে সময়টা হয়তো অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে না।

পুরনো খবর:
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.