তারুণ্যের জয়ে উজ্জ্বল সেরা বাঙালির আসর
কে বলে, দলবাজি আর হাঁউমাঁউ সংস্কৃতির বাইরে বাঙালি আর কিছু জানে না! সুড়ঙ্গে ২৭ কিমি লম্বা ‘লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার’-এ শূন্যের থেকেও কম, -২৭১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কণাদের ছুটোছুটির হিসেব করে ঈশ্বর-কণার অস্তিত্বও টের পায় বাঙালি।
মুম্বইয়ের টি আই এফ আর (টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ)-এর ফেলো, সেই বাঙালি বিজ্ঞানীই সুনন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। গত বছর জেনেভার সার্ন ল্যাবরেটরির নেতৃত্বে যে বিজ্ঞানীরা ‘হিগ্স বোসন’ বা ঈশ্বর-কণা আবিষ্কার করলেন, সুনন্দবাবু তাঁদেরই অন্যতম। বিজ্ঞানমহলে রসিকতা, ঈশ্বর-কণার পিছনে আর যে-ই থাকুন, ঈশ্বর নেই। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আইটিসি সোনার হোটেলে এবিপি আনন্দের ‘সেরা বাঙালি’ জানাল, ঈশ্বর না থাকলেও সেই কণা সন্ধানের পিছনে এক বঙ্গসন্তানের প্রগাঢ় পরিশ্রম ছিল। আনন্দবাজার সংস্থার প্রধান সম্পাদক অভীক সরকার তাঁর হাতেই তুলে দিলেন ‘সেরার সেরা’ বাঙালির শ্রদ্ধার্ঘ্য।
সুনন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে ‘সেরার সেরা বাঙালি’র সম্মান স্মারক তুলে
দিচ্ছেন আনন্দবাজার সংস্থার প্রধান সম্পাদক অভীক সরকার।
স্কটিশচার্চ স্কুল এবং প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন ছাত্র সুনন্দবাবু ’৭২ সালে কলকাতা ছাড়ার পর বছর তিনেক আগে এই শহরে ফিরে এসেছেন। মাঝেও ছুটিছাটায়, নানা কাজে এসেছেন। শহরের বদলে-যাওয়া চেহারাটা তাঁর চেনা! কিন্তু বাঙালি বাবা ও ব্রিটিশ মায়ের সন্তান অনিতা সেনগুপ্ত? ব্রিটেনেই জন্ম এবং বেড়ে-ওঠা তাঁর। গত বছর মঙ্গলগ্রহে পা রাখল কৌতূহল বা ‘কিউরিওসিটি’ নামের যে যান, তার পিছনে নাসার ‘জেট প্রপালসন ল্যাবরেটরি’র এই বিজ্ঞানী। প্রবাসী বিজ্ঞানী, প্রয়াত শ্যামল সেনগুপ্তের কন্যার নেতৃত্বেই এখন নাসায় তৈরি হচ্ছে ‘কোল্ড অ্যাটম ল্যাবরেটরি’। পুরোদস্তুর তৈরির পর আগামী ২০১৬ সালে সেটি মহাকাশে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস সেন্টারের সঙ্গে জুড়ে যাবে। হিমাঙ্কেরও নীচের তাপমাত্রায় যে সব বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করা দরকার, আর তিন বছর পর তা স্বচ্ছন্দে করা যাবে মহাশূন্যে বঙ্গতনয়ার সৃষ্ট সেই পরীক্ষাগারে। অনিতা-ই এ বারের সেরা বাঙালি বিজ্ঞানী। বুধবার রাতে মুম্বইয়ে নেমে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন কিউরিওসিটি-র এক বছর পূর্তিতে নাসায় আলোচনাচক্রের ছবি। ভাষাটা ঠিকঠাক বলতে পারেন না, কিন্তু সংস্কৃতিতে পুরোদস্তুর শাড়ি-পরা বাঙালি।
‘সেরা বাঙালি’ অনুষ্ঠানে (বাঁ দিক থেকে) প্রীতম চক্রবর্তী, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়,
সুজয় ঘোষ, সমীর চৌধুরী, পরেশ মাইতি, অভীক সরকার, সুনন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়,
সোহিনী সেনগুপ্ত, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, ছন্দা গায়েন,
অনিতা সেনগুপ্ত ও জয়দীপ কর্মকার। বৃহস্পতিবার দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি।
“ও আমাদের থেকেও বেশি বাঙালি। রেগুলার ফেসবুকে যোগাযোগ রাখে, শাড়ি পরা থেকেবাঙালি রান্না অনেক কিছুর টিপস নেয়,” বলছিলেন তাঁর কাকা। এই বিজ্ঞানী কন্যার হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন বেঙ্গালুরুর ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস-এর সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়।
এটাই নবম সেরা বাঙালি অনুষ্ঠানের অন্যতম ছবি। যেখানে বাঙালি মানে শুধুই পশ্চিমবঙ্গের চেনা মুখের প্রাধান্য নয়। নয় প্রবীণত্বের জয়গান। বরং প্রবীণ সেখানে পুরস্কার তুলে দেন বিদেশে বেড়ে-ওঠা নবীনার হাতে। ‘আমরা এমন কিছু কৃতী বাঙালির সন্ধান করি, যাঁরা কেবল নিজের নিজের বিষয়ে শ্রেষ্ঠ নন। যাঁদের কৃতিত্ব নিজের ভাষা বা রাজ্যের গন্ডি ছাপিয়ে একটা বড় পৃথিবীতে মর্যাদা দাবি করে,’ বলছিলেন অভীকবাবু।
সেই বৃহত্তর পৃথিবীতেই এ বার মা-বাবা ও কন্যার মিলন। অভিনয়ের সেরা বাঙালি সোহিনী সেনগুপ্তের হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন রুদ্রপ্রসাদ ও স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। সোহিনীই তো মঞ্চে ফুটিয়ে তুলেছেন মহাভারতের ঋষিকন্যা ‘মাধবী’ থেকে আজকের ‘নাচনী’র ট্র্যাজেডি। কিংবা ‘ইচ্ছে’ ছবির পজেসিভ মা, ‘অলীক সুখে’র কবিতা। গত শুক্রবারই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন, এক সপ্তাহের মধ্যেই সেরার পুরস্কার। এবং তাও মা-বাবার হাত থেকে। “বাবা আওয়াজ দিচ্ছেন, খুব তো একক নারী হয়ে ছিলে! বিয়ে তো সেই করতেই হল,” বিয়ের পরপরই এক আড্ডায় এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন তিনি।
সারা জীবনের অবদানের জন্য স্বীকৃতি পেলেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত।
বৃহস্পতিবার আইটিসি সোনার হোটেলে।
সেই ‘বাবা’, নান্দীকার পরিবারের কর্তা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তই সম্মানিত এ বারের লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্টে। কে ভুলতে পারে, তাঁর ‘খড়ির গণ্ডি’, ‘ফেরিওয়ালার মৃত্যু’? কিংবা ‘ফুটবল’ নাটকে ‘মারাদোনার একটা ছবি লিবি বে’ বলে হেঁকে যাওয়া কালীদাকে। রুদ্রপ্রসাদের নেতৃত্বেই তো এই কলকাতার নাটক ক্ষুদ্র গন্ডি ছেড়ে বেরিয়েছে, শীতের কলকাতায় বছরের পর বছর অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘নান্দীকার নাট্যোৎসব’। তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন সুমন মুখোপাধ্যায় ও কৌশিক সেন। প্রবীণের হাতে দুই নবীনের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
সেরাদের অবশ্য নবীন-প্রবীণ হয় না। সাহিত্যে সেরা বাঙালি: শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন নবনীতা দেবসেন। ‘সিনি’র স্রষ্টা, সমীর চৌধুরীর হাতে সমাজসেবায় সেরা বাঙালির পুরস্কার তুলে দিলেন প্রাক্তন অর্থসচিব সুনীল মিত্র। দরিদ্র শিশুদের চিকিৎসা নিয়ে আজীবন পড়ে থেকেছেন সমীরবাবু, এ দিনও বলছিলেন, অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সে পড়ার সময় এক সমীক্ষা করতে করতে তিনি পরিষ্কার বুঝে গিয়েছিলেন, অপুষ্টি কোনও শারীরিক রোগ নয়। একটি সামাজিক অসুখ। খাদ্য সুরক্ষা নিয়ে তুলকালাম এই সময়ে সেরা সমাজসেবী বাঙালি এই ভাবেই নিরুচ্চারে জানিয়ে গেলেন তাঁর উপলব্ধি।
চিত্রকলায় সেরা বাঙালি: পরেশ মাইতি। তমলুকের ছেলের হাতে আঁকা জলরং, তেল রং, অ্যাক্রিলিকে গত কয়েক বছর ধরেই মজে তামাম চিত্ররসিকেরা। তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দেন ‘ফেলুদা’ সব্যসাচী চক্রবর্তী।
‘এবিপি আনন্দ সেরা বাঙালি ২০১৩’ অনুষ্ঠানে জিৎ এবং কোয়েল।
বৃহস্পতিবার, শহরের এক হোটেলে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
সুমন দে আর স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় সঞ্চালিত অনুষ্ঠানে এ সবের পাশাপাশিই থাকল নবীনদের প্রয়াসকে জীবন্ত কিংবদন্তিদের সম্মানদান। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যেমন এ দিন পুরস্কার তুলে দিলেন শু্যটার জয়দীপ কর্মকারের হাতে। গত লন্ডন অলিম্পিকে রাইফেল শু্যটিংয়ে অল্পের জন্য ব্রোঞ্জ পিছলে গিয়েছে জয়দীপের হাত থেকে। কিন্তু সেরা বাঙালি তো শুধু অতীতে তাকায় না, সে ভবিষ্যতেরও স্বপ্ন দেখে। জিৎ-কোয়েলের জনপ্রিয় জুটি যেমন পুরস্কার তুলে দিল এ বারের সেরা আবিষ্কার ছন্দা গায়েনের হাতে। এভারেস্ট-শীর্ষে পা রাখা তৃতীয় বঙ্গনারী। কিন্তু তাঁর আগে দার্জিলিঙের কুং ভুটিয়া, মেজর শিপ্রা মজুমদার দু’জনেই ছিলেন সেনাবাহিনিতে। হাওড়ার মেয়ে ছন্দা সেখানে পুরোদস্তুর সিভিলিয়ান। এবং এভারেস্ট জয় করেই থেমে থাকেননি, তার দিন কয়েকের মধ্যে উঠেছেন ৮০০০ মিটারের আর এক শৃঙ্গ লোৎসেতে। যে রাঁধে, সে পিঠে স্যাকও বাঁধে!
সঙ্গীতে সেরা: প্রীতম। ‘ধুম’ থেকে ‘বরফি’, ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’...এই বাঙালি ছেলের সুরেই মেতেছে তামাম ভারত। দুই দশক আগেও প্রেসিডেন্সি কলেজে (তখনও বিশ্ববিদ্যালয় ভবিষ্যতের গর্ভে) প্রমোদের ক্যান্টিনে গিটার বাজাতে গিয়ে প্রীতম বারংবার সিনিয়ারদের আওয়াজ খেয়েছেন, ‘এই, এখানে ট্যাং ট্যাং করবি না।’ কিন্তু বাঙালির প্রতিভাকে চেপে রাখবে কে? সিনেমায় সেরা পরিচালকও প্রীতমের মতোই মুম্বইবাসী বাঙালি: সুজয় ঘোষ। ‘কহানি’ ছবির পরিচালককে আর কয়েক দিন পরেই দেখা যাবে ঋতুপর্ণের শেষ ছবিতে ব্যোমকেশ বক্সীর ভূমিকায়। শুধু নবীন-প্রবীণ নয়, দুই ব্যোমকেশের মিলনও ঘটিয়ে দিল এই দিনের অনুষ্ঠান। সুজয়ের হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন আবীর চট্টোপাধ্যায়।
অর্থাৎ, শেষ কথা একটাই। তারুণ্যের জয়! সোহিনী, সুজয়, প্রীতম, অনিতা, ছন্দা গায়েন, পরেশ মাইতি, জয়দীপ এই সাত জনের বয়সই পঞ্চাশের নীচে। সেরার সেরা বাঙালিরা তো বরাবর এই তারুণ্যকে বরণ করে নেওয়ার কথাই বলেছেন। বাঙালির ব্যর্থতা যে তার পিছুটানে, সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এক ভদ্রলোক লিখেছিলেন, ‘সম্মুখে চলিবার প্রবলতম বাধা আমাদের পশ্চাতে; আমাদের অতীত তাহার সম্মোহন বাণ দিয়া ভবিষ্যৎকে আক্রমণ করিয়াছে।’
ঘটনাচক্রে সেই বাধা কাটিয়ে ওঠা বৃষ্টিভেজা বৃহস্পতিবারটি ছিল ২২ শ্রাবণ। তাঁর মৃত্যুর ৭২ বছর পূর্তি।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.