লালদিঘির পাড়ের লালবাড়িতে তালা ঝুলতে চলেছে! অন্তত কিছু দিনের জন্য! স্বাধীনতার পর থেকে মহাকরণের ইতিহাসে এমন ঘটনা এই প্রথম!
আগামী ১ অক্টোবর থেকে বিবাদী বাগের অফিসপাড়ার ভিড় অনেকটা পাতলা হয়ে যাবে। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের সর্বকনিষ্ঠ কেরানি, কেউই আর মহাকরণে আপিস করতে আসবেন না! কয়েক মাসের জন্য রীতিমতো তালা ঝুলিয়ে আমূল সংস্কার করা হবে এই ঐতিহাসিক ভবনটির। সরকারি দফতরগুলো তখন সাময়িক ভাবে সরে যাবে দ্বিতীয় হুগলি সেতু পেরিয়ে হাওড়ার মন্দিরতলায় এইচআরবিসি-র ১৪ তলা ভবনে।
আড়াইশো বছরের পুরনো রাইটার্স বিল্ডিংই কলকাতার বুকে মাথা তোলা প্রথম তিন তলা বাড়ি। সরকারি সূত্রের খবর, পুরো সংস্কারের কাজ মিটতে সময় লাগবে প্রায় ছ’মাস। তত দিন অবধি প্রশাসনের কাজ চলবে গঙ্গার ও-পার থেকে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে বুধবার মহাকরণে বলেন, “১ অক্টোবর থেকে তিন-চার মাসের জন্য আমরা সবাই চলে যাব এইচআরবিসি-র ১৪ তলা ভবনে। আমিও যাব। সেই সময়ে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের সংস্কার করা হবে। তবে তার ঐতিহাসিক কাঠামো বজায় রাখা হবে। পরে আমরা আবার ফিরে আসব।”
একই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন ঘোষণা করেছেন, মহাকরণের সংস্কারের পাশাপাশি হাওড়ার ডুমুরজলা স্টেডিয়ামের পাশে ৫০ একর জায়গায় আরও একটি প্রশাসনিক ভবন তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ভবিষ্যতে কিছু দফতর পাকাপাকি ভাবে সেখানে চলে যাবে বলে ঠিক হয়েছে। কোন কোন দফতর যাবে, তা অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী জানাননি। প্রশাসনিক সূত্রেও স্পষ্ট উত্তর মেলেনি। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “এটা আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। কিন্তু এগুলি তৈরি করা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়।” |
ইংরেজ আমলে ১৭৭৬ সালে তরুণ ‘রাইটার’ বা কেরানিদের থাকার জন্য লালদিঘির পাড়ে একটি ভবন তৈরির কাজ শুরু হয়। সময় লাগে মোটামুটি তিন বছর। একতলায় ছিল গুদাম ও ভাঁড়ার। উপরে থাকতেন কেরানিরা। লেফটেন্যান্ট গভর্নর অ্যাশলে ইডেনের সময় (১৮৭৭-১৮৮২) স্থপতি ই জে মার্টিনের নকশায় গথিক স্থাপত্যরীতিতে বাড়িটিকে নতুন চেহারা দেওয়া হয়। তখন থেকেই মহাকরণ প্রশাসনিক কাজকর্মের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে।
স্বাধীনতার পর থেকে এই মহাকরণই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সদর দফতর। চাপ কমানোর জন্য পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে মহাকরণের এলাকার মধ্যেই চারটি নতুন ভবন তৈরি করা হয়। যার মধ্যে দু’টি ভবন পাঁচতলা, একটি চারতলা এবং অন্যটি দোতলা। তার পর থেকে ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে মহাকরণের আকার বর্তমানে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ বর্গফুট।
একটা সময়ে মহাকরণের চাপ কমাতে কাছেই স্ট্র্যান্ড রোডের পাশে তৈরি করা হয় নব-মহাকরণ ভবন। এর পরে একে একে সল্টলেক থেকে ক্যামাক স্ট্রিট শহরের বিভিন্ন জায়গায় নানা দফতরের অফিসবাড়ি তৈরি হয়েছে। কিন্তু রাজ্যের প্রধান প্রশাসনিক ভবন বলতে এখনও লালবাড়িকেই বোঝায়। ঢুকলেই দেখা যায়, বড় বড় ঘরে কাঠের পার্টিশন দিয়ে ছোট ছোট অসংখ্য খুপরি ঘর। খুপরি যত বেড়েছে, তার সঙ্গে মহাকরণের দেওয়ালে বেড়েছে তারের জঙ্গল। বিভিন্ন সময়ে মহাকরণের আমূল সংস্কারের কথা ভাবা হলেও তা এত কাল খাতায়-কলমেই থেকে গিয়েছে। অগ্নি-নিরাপত্তা থেকে বিভিন্ন পরিকাঠামো তৈরির ভাবনাও ভাবনাই রয়ে গিয়েছে। কেন? পূর্ত দফতরের এক কর্তার কথায়, “মহাকরণের সংস্কার করতে গেলে একসঙ্গে অনেক দিন ফাঁকা পাওয়া প্রয়োজন। সেটাই পাওয়া যায় না। নব্বইয়ের দশকে এক বার পুজোর সময়ে কিছুটা সংস্কারের কাজ করা হয়েছিল। বাকি সময়ে যা হয়েছে, তা একেবারেই জোড়াতালি কাজ।”
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পরে প্রথমেই মহাকরণের আমূল সংস্কারের কথা বলেছিলেন। কী ভাবে মহাকরণের চাপ হালকা করা যায়, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে থাকেন। মহাকরণের ঠিক উল্টো দিকে লালদিঘির পাশের জমিতে আরও একটি নব-মহাকরণ তৈরি করার কথা ভেবেছেন তিনি। তা ছাড়া গঙ্গার পাড়ে আর একটি প্রশাসনিক ভবন তৈরি করে পুলিশের কর্তাব্যক্তি এবং অফিসগুলি সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চিন্তাও রয়েছে তাঁর।
২০১১ সালের ৯ ডিসেম্বর আমরি হাসপাতালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরে মহাকরণে অগ্নি-নিরাপত্তা নিয়েও নড়েচড়ে বসেন প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা। দমকল এবং পুলিশের পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট পাঠিয়ে মহাকরণের অগ্নি-নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তদানীন্তন মুখ্যসচিব সমর ঘোষ। বিভিন্ন মন্ত্রীর ঘরে কোনও রকম অনুমতির তোয়াক্কা না করে কাঠের অন্দরসজ্জা এবং এসি মেশিন বসানো শুরু হয়েছিল। তখনও সমরবাবু নির্দেশ দিয়েছিলেন, পূর্ত দফতরের অনুমতি ছাড়া কোনও ঘরে কোনও পরিবর্তন করা যাবে না। বস্তুত ওই সময় থেকেই মহাকরণের আমূল সংস্কারের ভাবনাচিন্তা শুরু হয় প্রশাসনের শীর্ষ স্তরে। |
লালবাড়ির কিস্সা |
• ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কেরানিদের (রাইটার ) বাসস্থান হিসেবে রাইটার্স বিল্ডিং
তৈরি শুরু ১৭৭৬ সালে। চুনবালির সাদামাঠা বাড়ি, নির্মাতা টমাস লায়ন।
• ১৮২১ -এ দোতলা আর তিন তলায় জোড়া হয় ১২৮ ফুট লম্বা বারান্দা।
সেই ছাদ ধরে রাখার জন্য স্তম্ভ প্রতিটি ৩২ ফুট উঁচু। |
|
|
১৮৮৫ সালের ছবি |
এইচআরবিসি বিল্ডিং |
|
• ১৮৭৭ সালে লেফটেনান্ট গভর্নর অ্যাশলে ইডেনের আমলে পুরোদস্তুর
প্রশাসনিক ভবনে পরিণত হয় বাড়িটি। ই জে মার্টিনের নকশায় গথিক স্থাপত্যরীতিতে
নতুন চেহারা নেয় রাইটার্স বিল্ডিং। জোড়া হয় তিনটি ব্লকও।
• ১৮৮৯ থেকে ১৯০৬ সালের মধ্যে তৈরি হয় আরও দু’টি নতুন ব্লক।
• দক্ষিণ পশ্চিম কোণে তৈরি হয় রোটান্ডা।
• স্বাধীনতার পরে মূল ব্লকগুলির মাঝে ফাঁকা জায়গায় তৈরি হয় চারটি ব্লক। |
|
হাওড়ার উপ-নির্বাচনের সময়ে এক দিন প্রচার সেরে ফেরার পথে মুখ্যমন্ত্রীর নজরে পড়ে হাওড়ায় এইচআরবিসি-র ১৪ তলা ভবনটি। তখনই তিনি প্রশাসনের কর্তাদের বলেন, সংস্কারের জন্য মহাকরণ ফাঁকা করতে হলে এই ভবনটি ব্যবহার করা যেতে পারে। তার পরে এ দিন বিকেল পাঁচটা নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী প্রথমে ডুমুরজলা এবং পরে এইচআরবিসি-র ওই ভবনটি দেখতে যান। সঙ্গে ছিলেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র, পূর্তসচিব ইন্দিবর পাণ্ডে, ক্রীড়াসচিব ভগবতীপ্রসাদ গোপালিকা এবং ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র-সহ পূর্ত দফতরের কর্তারা।
মহাকরণে ফিরে এসেই মুখ্যমন্ত্রী এ দিন ১ অক্টোবর থেকে এইচআরবিসি-র ভবনে মহাকরণ সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেন। পূর্ত দফতর সূত্রের খবর, ওই ভবনটিকে কী ভাবে মহাকরণের বিকল্প হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তা নিয়ে পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। ভবনটির উল্টো দিকে চার তলা গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা তৈরি হচ্ছে। সেই কাজ যাতে এই দেড় মাসের মধ্যে শেষ করা যায়, সে ব্যাপারেও পূর্ত দফতর উদ্যোগী হবে বলে জানিয়েছেন পূর্ত দফতরের এক কর্তা।
মুখ্যমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তের অবশ্য বিরোধিতা করেছে সিপিএম প্রভাবিত সরকারি কর্মী সংগঠন কো-অর্ডিনেশন কমিটি। সংগঠনের নেতা অনন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “মহাকরণের সংস্কার সরকার করুক, তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যে কোনও সিদ্ধান্তই ইচ্ছে মতো নিতে অভ্যস্ত। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কর্মীদের মতামত ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।” আইএনটিইউসি অনুমোদিত কনফেডারেশন অফ স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ-এর নেতা মলয় মুখোপাধ্যায় বলেন, “শহরের কেন্দ্রস্থলে মহাকরণ হওয়ার কিছু সুবিধা আছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে কর্মীরা এবং জনগণ সহজেই মহাকরণে আসতে পারেন। কিন্তু যে দু’টি জায়গায় মহাকরণ সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা হয়েছে, সেখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে আসার ব্যাপারে খুবই অসুবিধা হবে। বিষয়টি ভাল করে ভাবনাচিন্তা করা উচিত।”
প্রতিদিন কর্মী এবং সাধারণ মানুষ মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার লোক মহাকরণে আসেন। দ্বিতীয় হুগলি সেতু দিয়ে গুটিকয়েক সরকারি বাস চলে। বিশাল সংখ্যক এই মানুষের চাপ কি তারা নিতে পারবে? পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র অবশ্য এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে চাননি। তাঁর কথায়, “পুরোটাই মুখ্যমন্ত্রীর ভাবনা। আমি তাঁর সঙ্গে ছিলাম। তিনিই সব কিছু ঠিক করবেন।” |