পৃথিবীর দুই প্রান্তে দুই নারীকে অপেক্ষা করতে হবে আরও সপ্তাহ দুয়েক। তার পরে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলে দেবে সত্যিই তাঁদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক রয়েছে কি না। বলে দেবে, হরিণঘাটার সাধনা আর সুইৎজারল্যান্ডের সোনা সত্যিই মা-মেয়ে কি না।
সোমবার পর্যন্ত অবশ্য দু’জনেরই বদ্ধমূল ধারণা, রক্তের সম্পর্কে তাঁরা বাঁধা। নদিয়ার হরিণঘাটায় অন্ধকার মাখামাখি কুঁড়েঘরে বসে সাধনা দেবনাথ মনে করছেন, সুইৎজারল্যান্ডের সোনা আসলে তাঁরই হারিয়ে যাওয়া মেয়ে। এ দিনই দুপুরে সুইৎজারল্যান্ড থেকে ফোনে সোনাও জানিয়েছেন, তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, হরিণঘাটার সাধনাই তাঁর জন্মদাত্রী মা।
তবুও ডিএনএ রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে চান সোনা। বিশ্বাসটা সত্যে রূপান্তরিত হলে তবে শান্তি। টেলিফোনে উচ্ছ্বসিত শোনায় সোনার কণ্ঠস্বর। কারণ এ দিন সকালেই নিজের লালা-র নমুনা পাঠিয়ে দিয়েছেন ডিএনএ পরীক্ষার জন্য। তবে সুইৎজারল্যান্ডে সেই পরীক্ষা হচ্ছে না। হবে নেদারল্যান্ডসের এক পরীক্ষাগারে। হরিণঘাটা থেকে আগেই সংগ্রহ করা হয়েছিল সাধনাদেবীর লালা-র নমুনা। সোনার বন্ধু অরুণ ডোল এ দিন সেই নমুনাও পাঠিয়ে দিয়েছেন জার্মানি থেকে। |
সোমবার সুইৎজারল্যান্ড থেকে সোনা বলেন, “আমাকে মা ও দিদির ফটো পাঠিয়েছে অরুণ। হাতের আঙুল, নখ এ সবের মিল রয়েছে। তবু ডিএনএ পরীক্ষা করে নেওয়াটাই উচিত।” কিন্তু সুইৎজারল্যান্ডে কেন পরীক্ষা হল না? সোনার কথায়, “খোঁজ নিয়ে দেখলাম, আমার মায়ের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ওঁর লিখিত অনুমতি নিতে হবে। আর সেটা ভারতে সুইস দূতাবাস মারফত করতে হবে। এত কিছু ওঁর পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাই ঠিক হয়েছে নেদারল্যান্ডসে করা হবে।” সোনার বান্ধবী অঞ্জলি পওয়ার শিশু পাচারের বিরুদ্ধে কাজ করেন। অঞ্জলির সংগঠন প্রায় ৩৩টি ক্ষেত্রে দত্তক সন্তানের সঙ্গে জন্মদাত্রীকে মিলিয়ে দিয়েছে। তাঁর কথায়, “ভারত-সহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই আদালত বা পুলিশের অনুমতি ছাড়া ডিএনএ পরীক্ষা করা যায় না। নেদারল্যান্ডসে এত কড়াকড়ি নেই।”
গত ৫ অগস্ট আনন্দবাজার-এ সোনার খবর প্রকাশিত হওয়ার পরে সাধনাদেবীর সম্পর্কে জানা যায় হরিণঘাটা থেকে। ছোট মেয়ে জন্মানোর চার মাসের মধ্যে স্বামী মারা যাওয়ায় সেই শিশুকন্যাকে অপয়া বলেছিল বাড়ির লোকজন। তাই সাধনাদেবী নিজের দিদির হাতে তুলে দিয়েছিলেন চার বছরের সেই মেয়েকে। সেই দিদিই আবার শিশুটিকে তুলে দেন হোম কর্তৃপক্ষের হাতে। সাধনাদেবী ও তাঁর আর এক মেয়ে কুসুমকে দেখে অঞ্জলি ও অরুণের দৃঢ় ধারণা, সোনার সঙ্গে তাঁদের মুখ ও চেহারার মিল রয়েছে।
জ্ঞান হওয়া ইস্তক সুইৎজারল্যান্ডের মুরান্ডি পরিবারে বেড়ে উঠেছেন সোনা। ছোটবেলায় জেনেছিলেন, ভারতের এক শহর থেকে তাঁকে দত্তক নিয়ে এসেছেন তাঁর পালিত বাবা-মা। কিন্তু সুইৎজারল্যান্ডের সংসার দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পালিতা মা ছেড়ে যাওয়ার পরে বাবা তাঁকে পাঠিয়ে দেন হোস্টেলে। এর পরে প্রথম যৌবনেই এক তামিল যুবক এসে বদলে দেন সোনার জীবন। তাঁদের বিয়ে হয়। স্বামী যশোধরন মুথুলিঙ্গমকে এক সময় সোনা বলেন, জন্মদাত্রী মাকে ফিরে পেতে চান তিনি। শুরু হয় খোঁজ। জানা যায়, কলকাতার একটি হোম থেকে এক গরিব মায়ের মেয়েকে দত্তক নিয়েছিলেন মুরান্ডি দম্পতি। ২০০২ সালে স্বামীকে নিয়ে কলকাতায় ঘুরেও যান সোনা। কিন্তু মায়ের খোঁজ পাননি। তার পরে সোনার হয়ে এই খোঁজ শুরু করেন জার্মানির যুবক অরুণ এবং পুণের অঞ্জলি পওয়ার। অরুণ নিজেও দত্তক সন্তান। ফিরে পেয়েছেন তাঁর জন্মদাত্রীকে।
সোনা কবে আসছেন কলকাতায়?
ইচ্ছে থাকলেও এক্ষুণি উপায় নেই। সোনার কথায়, “আমরা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। ইচ্ছে করলেই সকলে মিলে কলকাতায় যাওয়া সম্ভব নয়।” সুইৎজারল্যান্ডে একটি সরকারি স্কুলে অস্থায়ী শিক্ষিকার কাজ করেন সোনা। কাজ মেলে সপ্তাহে আড়াই দিন। সংসারের খরচ সামলিয়ে এত দিনে যেটুকু জমাতে পেরেছিলেন, মায়ের খোঁজ চালাতেই খরচ হয়ে গিয়েছে। ২০০২ সালে কলকাতায় এসে এক দফা খরচ হয়েছিল। সম্প্রতি অরুণ ও অঞ্জলির কলকাতায় আসার সব খরচও বহন করেছেন সোনা। স্বামী ১৭ বছর বয়সে শ্রীলঙ্কা থেকে পালিয়ে আশ্রয় পেয়েছিলেন ওই দেশে। খুব উচ্চপদে চাকরি করার মতো পড়াশোনা তিনিও করতে পারেননি। আপাতত স্থানীয় একটি ডাকঘরে কাজ করেন তিনি। সঙ্গে তিন সন্তান। কলকাতায় আসার জন্য টাকার জোগাড় করা তাই সহজ নয়। টাকা জোগাড় হলে আপাতত একাই কলকাতায় আসবেন সোনা। হরিণঘাটা থেকে সোনার দিদি কুসুম জানিয়েছেন, ছোট মেয়ের চিন্তায় নাওয়া-খাওয়া প্রায় ভুলতে বসেছেন সাধনাদেবী।
|