ইতিহাস বইয়ের পাতা ঘাঁটলেই সন্ধান মেলে গার্গী, অপালা, মৈত্রেয়ীদের। পুরাণের পাতায় সযত্নে লেখা রয়েছে সেই বিদূষীদের কথা, যাঁরা প্রথম পুরুষতান্ত্রিকতার বেড়াজাল ডিঙিয়ে নিজেদের কণ্ঠস্বর পৌঁছে দিয়েছিলেন চার দেওয়ালের বাইরে বৃহত্তর পরিসরে। সময় গড়িয়েছে। পুরুষতন্ত্র আর তার দোসর সমাজ মেয়েদের ঘরবন্দি করে রাখার কৌশল বদলেছে। পাল্লা দিয়েছে মেয়েরাও। ঘরে, বাইরে হয়রানি আর নির্যাতনকে ভয় না পেয়ে নিজেদের ছড়িয়ে দিয়েছে সমাজের কেন্দ্র থেকে সীমান্তে।
মাতৃশক্তির আরাধনায় এই ভাবনাকেই উপচার হিসেবে গ্রহণ করে সেজে উঠছে ৬৬ পল্লি সর্বজনীন। শিল্পী অমর সরকারের ভাবনায় এই মণ্ডপে উঠে আসছে সেই সব মেয়ের উপাখ্যান, যাঁদের নিয়ে পুরাণ লেখা হয়নি, যাঁরা উপন্যাসের নায়িকাও নন, তবুও জড়িয়ে আমাদের প্রাত্যহিকতায়। এক উদ্যোক্তা বললেন, “যে নারী আমার-আপনার বাড়ির পরিচারিকা, যে চাষি-বৌ নিজে অভুক্ত থেকে তাঁর বাচ্চাদের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দেন হাসিমুখে, যে মা সংসারের জোয়াল টেনে কর্পোরেট অফিসের ব্যস্ত ডিউটি সামলান নিখুঁত ভাবে সেই ‘মা’-দের কথা বলতেই এ বছরের ভাবনা ‘আমার দুর্গা’।
দুর্গা শুধু শক্তিরূপ নন, দুর্গা মানে সৃষ্টিও। তাই ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পৌরাণিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বৈষ্ণবঘাটা পশ্চিমপাড়া সর্বজনীন দুর্গোত্সবের থিম। শিল্পী বাসুদেব পাল জানালেন, মূল মণ্ডপে ঢোকার আগেই থাকবে অনন্তশয্যায় শায়িত বিষ্ণু এবং তাঁর নাভিমূল থেকে ব্রহ্মার জন্মবৃত্তান্ত। মণ্ডপে তৈরি হচ্ছে মহাশূন্য। অন্ধকার প্রেক্ষাপটে আলোর খেলায় ভাসমান উল্কা, তারা, ছায়াপথ। প্রতিমাও ভাসমান। বেলতলা সর্বজনীন এ বছর পা দিচ্ছে ৬১ বছরে। দশম শতাব্দীর প্রাচীন দুর্গা মূর্তির ছবি মাথায় রেখে প্রতিমা গড়ছেন তাঁরা। মণ্ডপ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের আদলে।
ইতিহাসের পাশাপাশি হাঁটে লোকগাথা। সেই গাথায় থাকে দেবতার মানব জন্মের নানা আখ্যান। এমনই এক আখ্যানকে রূপ দিচ্ছে মৈত্রী সঙ্ঘ দুর্গাপূজা কমিটি। নীলমাধব থেকে জগন্নাথদেবের জন্মের আখ্যান ফুটে উঠছে মাটি, থার্মোকলের ব্যবহারে। রথের আকারে মণ্ডপ। দুর্গার রূপে জগন্নাথদেবের অবয়ব।
জোড়াসাঁকো সাতের পল্লি সর্বজনীনে আবার মা দুর্গার রুদ্র রূপ। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের মূর্তি পেরিয়ে পৌঁছতে হবে মূল মণ্ডপে। সেখানে দেবী বিরাজ করবেন চণ্ডীরূপে। ঋক্বেদ থেকে মহাকাব্যে বার বার প্রকাশ পেয়েছে হিংস্র বলি প্রথা। এই নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে এ বার এগিয়ে এসেছে নিমতলা সর্বজনীন। মাতৃমূর্তির চোখ হবে সিক্ত, আর সামনে থাকবে হাঁড়িকাঠ। এক উদ্যোক্তা জানালেন, তাঁদের উদ্দেশ্য সকলের কাছে এ বার্তা পৌঁছে দেওয়া দেবী রক্তপিপাসু নন, তিনি মা। প্রতিটি জীবই তাঁর কাছে সন্তানসম।
মানিকতলা বারোয়ারি দুর্গাপূজা কমিটির থিম ‘সৃষ্টিতে ফেরা’। মণ্ডপ কেদারনাথ মন্দিরের অনুকরণে। নটরাজের তাণ্ডব রূপ নয়, সৃষ্টিরূপের আরাধনা এখানে। সৃষ্টির আদি মহাদেব। কখনও তিনি তালবাদ্যের দেবতা নটরাজ, কখনও বিশ্বের নিয়ন্ত্রক, গৃহী কখনও বা। শিব-মাহাত্ম্যের এমনই নানা গাথায় সাজছে শ্রী সঙ্ঘের মণ্ডপ। মানসবাগ সর্বজনীনের থিম শিবের বিয়ে। এখানে শিব-পার্বতীর বিয়েতে ত্রিলোকের দেব-নর-অসুরের উপস্থিতির দৃশ্য তৈরি হচ্ছে বাঁশ, কাগজ, প্লাইবোর্ড, মাটি, ভেষজ রঙের ব্যবহারে। প্রতিমা গড়া হচ্ছে কৃষ্ণনগরের ছাঁচে।
দমদম তরুণ দলের পুজোয় উঠে আসছে উমার স্বামী, সংসারী শিবের কথা। গাঁজা আর হুঁকো ছাড়া যাঁর একদণ্ড চলে না। মণ্ডপসজ্জায় ব্যবহার করা হচ্ছে পঁচিশ ফুট লম্বা ৫টি হুঁকো এবং প্রায় ৫ লক্ষ গাঁজার কল্কে। হুঁকোর গায়ে শিল্পীর তুলির টানে মূর্ত হচ্ছে কালীঘাট পটচিত্র। একটি বড় হুঁকোর গায়ে ত্রিমাত্রিক ভাবে ফুটে উঠবে মাতৃমূর্তি। এ বছর ৯৫-এ পা গড়পার মাতৃমন্দিরের। অন্য রকম কিছু করার ইচ্ছা নিয়ে থিমের ভিড়ে সাবেক রীতি মেনে মণ্ডপ সাজছে। প্রতিমাও সাবেক একচালা।
বাঁশ বাঁধার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। চায়ের দোকান থেকে টিভি চ্যানেল সর্বত্র একটাই প্রশ্ন আর যেন ক’দিন বাকি? আর ঘরে ঘরে উমাদের মন উচাটন। পিতৃগৃহে যাওয়ার সময় এল যে...
|