এক শিশুর আকস্মিক মৃত্যু। আর সেই দুর্ঘটনার কুম্ভীপাকে লন্ডভন্ড একসঙ্গে অনেক শিশুর জীবন।
ক্লাস ফাইভের ছাত্রী ঐন্দ্রিলার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তাণ্ডবের জেরে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে দমদম ক্রাইস্ট চার্চ স্কুল। মাঝপথে থমকে গিয়েছে প্রি-টেস্ট পরীক্ষাও। ফলে দশম শ্রেণির পড়ুয়ারা অথৈ জলে। কবে আবার স্কুল খুলবে, কবে পরীক্ষা হবে জানতে না পেরে দিন কাটছে উদ্বেগে। দিশেহারা অন্য ক্লাসের পড়ুয়ারাও। পুজোর ছুটির আগে এই সময়টা সিলেবাস অনেকটা এগিয়ে যায়। এই বছরই তার ব্যতিক্রম। তার উপর গত ক’দিন ধরে স্কুলের বড়দির গ্রেফতার হওয়া থেকে শুরু করে স্কুল নিয়ে নানা ঘটনা আর খবরের ধাক্কায় ক্রাইস্ট চার্চের প্রায় তিন হাজার শিশুর লেখাপড়ার জগৎটাই যেন গুলিয়ে গিয়েছে!
এখানেই শেষ নয়। গত ক’দিনের ঘটনার জেরে আরও কয়েকটি শিশুর জীবনটাই তো বদলে গিয়েছে। যেমন ক্রাইস্ট চার্চের অধ্যক্ষা হেলেন সরকারের এগারো বছরের মেয়ে। মারমুখী জনতার সামনে মাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। তিন দিন পুলিশি হেফাজতে থাকতে হয়েছে মাকে। আর তাতেই পৃথিবী দুলে গিয়েছে মেয়েটির। সে নিজেও একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ক্লাস ফাইভের ছাত্রী। মা-কে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পরে মামা তাকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছেন।
মা-কে দেখতে না পেয়ে আতঙ্ক আর অবসাদ গ্রাস করেছে তাকে। মনোচিকিৎসকেরা বলছেন, এই স্মৃতি হয়তো সারা জীবনই তাড়া করে বেড়াবে ছোট্ট মেয়েটিকে।
হেলেন সরকারের স্কুলে ওই দিন যাঁরা হামলা চালিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে গ্রেফতার হওয়া কয়েক জনের শিশু-ও ঘটনাচক্রে একই বিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে। হামলায় ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছেন মুমু চন্দ এবং রূপা পাল। স্কুলে ভাঙচুরের ঘটনায় এই দুই অভিভাবকের রুদ্র মূর্তি দেখে স্তম্ভিত হয়েছিলেন অনেকে। সংবাদপত্রেও ছাপা হয়েছিল তাঁদের সেই তাণ্ডবের ছবি। রবিবার ছেলেমেয়েদের সামনেই পুলিশ এসে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় তাঁদের। গ্রেফতার হন তাঁদের স্বামীরাও। দু’জনের পরিবারই জানিয়েছে, এই ঘটনায় মাত্রাতিরিক্ত মানসিক ধাক্কায় এক্কেবারে চুপ করে গিয়েছে তাঁদের মেয়েরা। এক জনের মেয়ে ক্রাইস্ট চার্চের ক্লাস সিক্সের পড়ুয়া। অন্য জনের ক্লাস থ্রি! রূপা পালের একটি তিন বছরের ছেলেও রয়েছে। সে এখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি। তাকে অনেক
কষ্টে বোঝানো হয়েছে, মা-র অসুখ করেছে বলে হাসপাতালে রয়েছেন। বাবাও সেখানেই রয়েছেন। পরিচিত কাউকে দেখলেই তিন বছরের
শিশু আধো গলায় মায়ের অসুখের কথা শোনাচ্ছে!
শিশুগুলোর এই পরিণতি, এই অসহায়তার দায় নেবে কে? অভিভাবক, স্কুল নাকি প্রশাসন?
দুঃখ করছিলেন রেভারেন্ড আবির অধিকারী। তিনি চার্চ অফ নর্থ ইন্ডিয়া (সিএনআই)-র কলকাতা ডায়োসেসের অনারারি সেক্রেটারি। ক্রাইস্ট চার্চ স্কুল এই সংস্থারই অধীনে। আবিরবাবুর কথায়, “ঐন্দ্রিলার মতো কোনও ছাত্রীর মৃত্যুই কাম্য নয়। কিন্তু কোনও ভাবে সেটা ঘটে গেলে কি অভিভাবকদের থেকে এই আচরণ আমাদের প্রাপ্য? তাঁরা একটুও ভাবলেন না, তাঁদের এই আচরণের মূল্য চোকাতে হতে পারে তাঁদেরই সন্তানকে।” প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও অসন্তুষ্ট আবিরবাবু বলেন, “প্রশাসনকেও কি আর একটু সংযত, সতর্ক ভূমিকায় দেখা যাওয়ার কথা ছিল না? তা হলে হয়তো এত ব্যাপক গোলমালই হত না। ভবিষ্যত টালমাটাল হত না এতগুলো শিশুর।”
সব শুনে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর মত, “আমার ‘এনিমি অফ পিপল’-এর কথা মনে পড়ছে। এই সব অভিভাবক বা মানুষরাই বোধহয় গণশত্রু! ন্যূনতম বাহ্যজ্ঞান, ন্যায়-অন্যায় বোধ সম্পর্কে যাঁরা অজ্ঞ! শুধু তাঁদের অবিমৃশ্যকারিতায় কিছু শিশুর জীবন অথৈ জলে পড়ল।” শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য প্রশাসনের দোষ মানতে নারাজ। তিনি বলেন, “প্রশাসন যে ভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে, তা প্রশংসনীয়। মুখ্যমন্ত্রী নিজে ঐন্দ্রিলার বাড়িতে ফোন করেছেন। আমি ওঁদের বাড়িতে সাংবাদিক বৈঠক করেছি। আর অধ্যক্ষাকে পুলিশ ওই অবস্থায় নিয়ে না এলে আইন-শৃঙ্খলার আরও অবনতি হতো।”
দু’পক্ষের মত যা-ই হোক, ভুক্তভোগী শিশুদের অবস্থার কোনও বদল কিন্তু হয়নি। সোমবার নাগেরবাজারের নগেন্দ্রনাথ রোডে মুমু চন্দের বাড়ি গিয়ে তাঁর মেয়েকে পাওয়া যায়নি। সন্ত্রস্ত ভাবে দরজা খুলে মেয়েটির কাকা ও এক বয়স্কা আত্মীয়া জানালেন, মেয়ের সামনেই পুলিশ এসে মুমু ও তাঁর স্বামী দেবাশিসকে গাড়িতে তোলে। ষষ্ঠ শ্রেণির মেয়েটি তখন অঝোরে চিৎকার করে কাঁদছিল। সেই অবস্থায় ওই একই গাড়িতে পুলিশ তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে নামিয়ে দেয় তার মামাবাড়িতে।
কাকার কথায়, “ওই ঘটনার পর থেকে হাসিখুশি মেয়েটা একদম চুপ করে গিয়েছে। খাওয়ানো যাচ্ছে না। শুধু কাঁদছে। বাইরে বেরোতেও চাইছে না।”
একই অবস্থা আর এক অভিভাবক রূপা পালের বাড়িরও। গভীর রাতে পুলিশ এসে তুলে নিয়ে গিয়েছে রূপা ও তাঁর স্বামী বরুণকে। বাড়িতে ক্লাস থ্রি-র ছোট্ট মেয়ে আর তার তিন বছরের ভাইকে দেখার জন্য এসেছেন রূপার মা-বাবা। দরজা খুলে দু’-একটা কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন রূপার মা। জানালেন, মেয়েটা থম মেরে আছে। ঘুমোচ্ছে না। ছেলেটি অত বুঝছে না, শুধু মা-বাবার কাছে যেতে চাইছে। খেলনা দিয়েও ভোলানো যাচ্ছে না।
ফেরার পথে ওই পাড়ারই এক ছোট্ট মনিহারি দোকানের বুড়ো দোকানি কথায়-কথায় মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “বাচ্চাগুলো আমার দোকান থেকে চিপস-চকোলেট কিনে খেত। আজ সকালে দেখলাম শুকনো মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।
সবাই মাথাটা ঠান্ডা রাখলে ওরা এত কষ্ট পেত না।”
|