ভীতু দুটো চোখ, ম্লান চেহারা আর হাবভাবে খানিকটা অস্থিরতা নিয়েই ছোট্ট মেয়েটা পৌঁছেছিল ডাক্তারের চেম্বারে। বাবা-মা জানিয়েছিলেন, মেয়ে কিছুই খেতে চাইছে না। সব সময়ে গুম হয়ে থাকছে। সে কথা শুনে মেয়েটার কাঁধে-মাথায় স্নেহের হাত রেখে ডাক্তারবাবু নরম সুরে প্রশ্ন করেছিলেন, “কী রে? কী হয়েছে তোর? খেতে ইচ্ছা করছে না?” ওই সামান্য কথাটুকুতেই জলে ভরে উঠেছিল মেয়েটির চোখ।
তখনই তার সঙ্গে আলাদা ভাবে কথা বলার প্রয়োজন টের পেয়েছিলেন শিশু চিকিৎসক দ্বৈপায়ন ঘটক। তাঁর দাবি, সামান্য অবকাশেই প্রথম বার দেখা ডাক্তারকে ঐন্দ্রিলা জানিয়েছিল, স্কুলে তার সমস্যার কথা। জানিয়েছিল, কী ভাবে উঁচু ক্লাসের কয়েক জন দিদি তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে, জোর করে টাকা চেয়েছে। কী ভাবে দিনের পর দিন তাকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করছে। কেন স্কুল যাওয়ার কথা ভাবলেই ইদানীং ভয় পাচ্ছে সে, এমন আরও কত কী! শেষে ডাক্তারকাকুর কাছে তার অনুরোধ ছিল, “প্লিজ, তুমি বাবা-মাকে এ সব কিছু বোলো না!”
দ্বৈপায়নবাবুর দাবি, পেশাগত কারণেই ওই অনুরোধ তিনি রাখতে পারেননি। চিকিৎসক হিসেবে তাঁর মনে হয়েছিল, বাবা-মায়ের এটা জানা দরকার। মেয়েটি যে ভয়ঙ্কর ‘ট্রমা’-র মধ্যে রয়েছে, সেটা সে দিনই মা-বাবাকে স্পষ্ট জানিয়েছিলেন তিনি।
পরের দিন সন্ধ্যায় মেয়েকে নিয়ে বাবা ফের হাজির চেম্বারে। মেয়েটির চেহারা তখন যেন আরও মলিন। হাঁটাচলা করতেও যেন কষ্ট হচ্ছিল তার। আবার কী হল? বাবা জানিয়েছিলেন, মেয়ের পেট ব্যথা হচ্ছে বলছে। আগের দিন দেখা সেই ভীতু চোখদুটো সায় দিয়েছিল বাবার কথায়। ব্যাপারটা ভাল ঠেকছে না জানিয়ে দ্রুত কোনও হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে শল্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলেছিলেন বলে দাবি দ্বৈপায়নবাবুর। তার পরের ঘটনাক্রম এখন সকলেরই জানা।
দ্বৈপায়নবাবু সোমবার বলেন, “তখন তো বুঝিনি, ব্যাপারটা কোন দিকে যাচ্ছে। চেম্বারে ভিড় থাকে। তার মধ্যেও সকলকে যতটা পারি সময় দেওয়ার চেষ্টা করি। এমন কোনও বিপদের আঁচ পেলে মেয়েটির সঙ্গে হয়তো আরও অনেক কথা বলতাম।”
যে নার্সিংহোমে এক রাতের জন্য ঐন্দ্রিলা ভর্তি হয়েছিল, সেখানকার চিকিৎসক-নার্সদের একাংশও তার ওই আতঙ্কিত আচরণের কথা উল্লেখ করেছেন। এক নার্সের দাবি, “বাচ্চাটা সব কথাতেই ভয় পাচ্ছিল। যেন সব কিছুতেই ও আতঙ্কিত। ‘বাবা-মাকে কিছু বোলো না’, এই কথাটা যে কত বার বলেছে...।”
ডাক্তার-নার্সদের যা বলা গেল, কেন বাবা-মাকে তা বলা যায়নি?
দ্বৈপায়নবাবু সরাসরি কোনও উত্তর দিতে চাননি। তাঁর দাবি, ঐন্দ্রিলা কোনও বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়। তাঁর কাছে যে শিশুরা আসে, তাদের একটা বড় অংশের মনের কথাই বাবা-মা জানেন না। কেন? তাঁর জবাব, “এক বছর আট মাস বয়স থেকে স্কুলে যায় বাচ্চারা। বাড়ি ফিরে আয়ার কাছে থাকে। বাবা-মা সময় দেন কতটুকু? আমার কাছে অভিভাবকরা যে বাচ্চাদের নিয়ে আসছেন, তারা অনেকেই কারও সঙ্গে ‘কমিউনিকেট’ করতে পারে না। অনেককেই আমি মনোবিদের সাহায্য নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। শুধু বাচ্চা নয়, বাবা-মাকেও।”
কেন নিজের পরিবারেই এমন গুটিয়ে ছিল ছোট্ট মেয়েটি?
ঐন্দ্রিলার বাবা শান্তনু দাস জানিয়েছেন, কেন এত বড় একটা সমস্যার কথা মেয়ে তাঁদের জানাল না, সেটা তাঁদের কাছেও ধোঁয়াশার। তিনি বলেন, “শেষের দিকে কয়েকটা দিন ও সব সময়ে মন খারাপ করে থাকত। জিজ্ঞাসা করলে বলত, কিছু ভাল লাগছে না। কেন আসল কারণটা বলল না, বুঝতে পারছি না। আমি বকব ভেবে আমাকে হয়তো অনেক কিছু বলত না। কিন্তু মায়ের তো খুব বাধ্য ছিল।”
শিশু চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানিয়েছেন, এখনকার ছোটরা তাদের আয়া, বাড়ির রান্নার লোক, এমনকী ড্রাইভারের সঙ্গেও মন খুলে কথা বলছে। কিন্তু বাবা-মা অনেক কিছু জানতে পারছেন না। তাদের স্কুলের সমস্যা, বন্ধুদের সমস্যা, বয়ঃসন্ধির সময়ে তাদের বেড়ে ওঠার সমস্যা, কিছুই বাড়ির লোকের কাছে স্পষ্ট নয়। অপূর্ববাবুর কথায়, “১১-১২ বছরের একটি মেয়েকে তার মা নিয়ে এসেছিলেন আমার কাছে। মেয়েটির সঙ্গে আলাদা ভাবে কথা বলে মনে হয়েছিল কোনও একটা ‘ইমোশনাল’ সমস্যা হচ্ছে ওর। মাকে সে কথা বলতেই তিনি উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘এ রকম কিছু হতেই পারে না। মেয়ে আমাকে সব বলে’। কিন্তু মেয়ে যে সব কথা মা-কে বলে না, সেটা পরে প্রমাণিত হয়েছিল। একে কী বলব? বাবা-মায়ের খানিকটা ব্যর্থতা তো রয়েছেই।”
শিশু চিকিৎসক সুব্রত চক্রবর্তীর কথায়, “শিশুদের মানসিক সমস্যায় দ্রুত হস্তক্ষেপ করলে পুরোপুরি সেরে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। কিছু কিছু বাবা-মা এটা মানতে চান না। সন্তানকে মনোবিদের কাছে নিয়ে যাওয়া কতটা জরুরি, সেটা তাঁদের বোঝানোই দুষ্কর হয়ে ওঠে।”
ঐন্দ্রিলার ঘটনাক্রম যতটুকু সামনে এসেছে, তাতে শিশু মনোবিদ তাপসী মিত্রের অনুমান, “নিজের সঙ্কটে যে নৈতিক সমর্থন প্রয়োজন, তা বাবা-মায়ের কাছে পাবে, এমন ভরসা হয়তো মেয়েটি পায়নি। তাই ডাক্তারের সামান্য স্নেহের কথাতেই ও নিজের সমস্যাটা বলতে পেরেছে।”
কেন এমন হয়? তাপসীদেবীর মতে, বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়ের সঙ্গে অনেকটা ‘কোয়ালিটি টাইম’ কাটানো দরকার এই সচেতনতাটা বহু সময়েই বাবা-মায়ের থাকে না। তাই ভরসার জায়গাটা তৈরি হয় না। নিজের সমস্যা নিজের মনের ভিতরে রেখে গুমরোতে থাকে বাচ্চাগুলো। তিনি বলেন, “এমন অনেক ছেলেমেয়ে ইদানীং আমাদের চেম্বারে আসছে। ঐন্দ্রিলার মনের ভিতরে ঠিক কী চলছিল, তার পুরো হদিশ আমরা পেলাম না। তার আগেই তাকে চলে যেতে হল। এই যন্ত্রণাটা যেন এখানেই শেষ না হয়, এ থেকে যেন আমরা সকলেই শিক্ষা
নিতে পারি।”
|