শনিবার থেকে স্কুলে যাচ্ছিল না দশ বছরের মেয়েটি। খাওয়াদাওয়াও প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। সব সময়ে গুটিসুটি মেরে ঘরের এক কোণে বসে থাকত পঞ্চম শ্রেণির ওই ছাত্রী ঐন্দ্রিলা দাস। বারবার জিজ্ঞাসা করলেও কোনও জবাব দিত না সে। মাঝেমধ্যে শুধু পেটে ব্যথার কথা বলত। কী হয়েছে, বুঝতে না পেরে বাড়ির লোকেরা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তারকে একান্তে ঐন্দ্রিলা যা বলেছিল, তাতে জানা যায়, সে তার স্কুলের উঁচু ক্লাসের দিদিদের র্যাগিংয়ের শিকার।
|
ঐন্দ্রিলা দাস |
সেই ডাক্তার ঐন্দ্রিলাকে এক জন শল্যচিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন। পাশাপাশি কোনও মনোবিদের কাউন্সেলিংও প্রয়োজন বলে জানান। গত সোমবার দমদমের এক নার্সিংহোমে ভর্তি করে শল্যচিকিৎসককে দেখানো হয়েছিল। কিন্তু সেই চিকিৎসক কোনও রোগ খুঁজে না পাওয়ায় মঙ্গলবার সকালে ঐন্দ্রিলাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সন্ধ্যায় এক স্নায়ু ও মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে মেয়েকে নিয়ে যান বাবা শান্তনু দাস। ঐন্দ্রিলার সঙ্গে কথা বলার পরে তিনি মেয়েটিকে উদ্বেগ কমানো এবং খিঁচুনি আটকানোর একটি ইঞ্জেকশন দেন। অভিযোগ, তার পর থেকেই ঐন্দ্রিলার শরীর আরও খারাপ হতে শুরু করে। বুধবার সকালে তার অবস্থার খুবই অবনতি হওয়ায় তাকে বাড়ি থেকে এক বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কিন্তু পথেই নেতিয়ে পড়ে সে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে চিকিৎসকেরা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
স্বভাবতই এই ঘটনার পরে স্কুলের দিকে অভিযোগের আঙুল উঠেছে। পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছে, যে পদ্ধতিতে ওই বালিকার চিকিৎসা চলছিল, তা আদৌ যথাযথ ছিল কি না।
এ দিন দমদম থানায় স্কুলের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে ঐন্দ্রিলার পরিবার। পুলিশ জানিয়েছে, তদন্ত শুরু হয়েছে। ঐন্দ্রিলার মৃতদেহ ময়না-তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে।
শান্তনুবাবু বলেন, “ডাক্তারের কাছে আমার মেয়ে জানায়, ক্লাস নাইনের কয়েক জন দিদি ওকে হেনস্থা করত। এক বার শৌচাগারেও বন্ধ করে রেখেছিল। ওর টিফিন খেয়ে নিত ওরা। ওকে ১০০ টাকা আনতে বলেছিল। না আনলে গলা টিপে মেরে ফেলবে বলেও হুমকি দিয়েছিল।”
দমদমের ওই স্কুলের অধ্যক্ষা হেলেন সরকার দাবি করেছেন, তাঁরা এই ঘটনার বিন্দুবিসর্গও জানতেন না। তিনি বলেন, “ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। কিন্তু মেয়েটির বাড়ির পক্ষ থেকে আমাদের কিছুই জানানো হয়নি।”
শিশু-রোগ চিকিৎসক এবং স্নায়ু ও মনোরোগ চিকিৎসক দায় এড়িয়েছেন। শিশু-রোগ চিকিৎসক দ্বৈপায়ন ঘটক বলেন, “মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছিল, ও ট্রমার মধ্যে রয়েছে। তাই মনোবিদ দেখাতে বলেছিলাম। আর পেটের ব্যথার উৎস জানতে শল্যচিকিৎসকের পরামর্শও নিতে বলি। আমার কাছে তখন এটাই সব চেয়ে জরুরি মনে হয়েছিল।” যে নার্সিংহোম থেকে শল্যচিকিৎসক দেখার পরে ঐন্দ্রিলাকে ছেড়ে দেওয়া হয়, তার কর্তৃপক্ষ জানান, উন্নত চিকিৎসার জন্য ওই বালিকাকে অন্যত্র রেফার করেছিলেন তাঁরা। অন্য দিকে, স্নায়ু ও মনোরোগ চিকিৎসক পার্থসারথি বিশ্বাস বলেন, “শুধু মানসিক চাপ তো নয়, মেয়েটির শরীরও খুব খারাপ ছিল। ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হয়েছিল। অনেক আগেই ওকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া প্রয়োজন ছিল। আমি সেটাই জানাই। মানসিক চাপে যাতে বাড়তি সমস্যা না হয়, তাই লোরাজিপাম গ্রুপের ওই ইঞ্জেকশনটি দিই। খুবই নিরাপদ ওষুধ ওটি। কোনও রকম খারাপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার কথাই নয়।”
এই চাপান-উতোর বা টানাপোড়েনের মধ্যেই যে প্রশ্নটি বড় হয়ে উঠেছে, তা হল এমন একটি বালিকা হঠাৎ ‘বড় ক্লাসের দিদি’দের আতঙ্কে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিল কেন? কী এমন ঘটেছিল, যার জেরে ওই শিশুর মানসিক চাপ ঘটনাচক্রে তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াল? প্রশ্ন উঠেছে, স্কুল-কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নির্দিষ্ট ভাবে জানতে না পারার কথা বললেও তাঁদের স্কুলে এই ধরনের পরিবেশ যে তৈরি হয়েছে, সেই দায় কি তাঁরা একেবারে এড়াতে পারেন? এই প্রশ্নে এ দিন স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষোভও জানান অনেক অভিভাবক।
শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, “ওই স্কুলটি সরকারি নয়। তা সত্ত্বেও আমি জেলা পরিদর্শককে গিয়ে বিষয়টি দেখতে বলেছি। দমদম পুরসভার চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানকেও স্কুলে পাঠানো হয়েছে।” তিনি জানান, আজ, বৃহস্পতিবার স্কুলে যাবে জেলা পরিদর্শক দলটি। মন্ত্রী বলেন, “পরিদর্শক দলের রিপোর্ট দেখে প্রয়োজনে দোষীদের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে যাতে এফআইআর করা হয়, সে ব্যাপারে স্কুলশিক্ষা দফতরের সচিবকে নির্দেশ দিয়েছি।” পুরসভার দলটি বুধবারই যায় ওই স্কুলে। মন্ত্রী জানান, দলটি জানিয়েছে, ঘটনাটি কয়েক দিন আগের। তবে প্রধান শিক্ষিকা বিষয়টি জানেন না বলে দাবি করেছেন। |