একতলার বারান্দা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে ভাঙা কাচ। একতলাতেই অডিটোরিয়াম। তার স্টেজের কাঠের ঘেরাটোপ টুকরো টুকরো করে ভাঙা। টিচার্সরুমের একটাও জানলা, চেয়ার-টেবিল আস্ত নেই। স্কুলের অফিস ঘরের তিনটি কম্পিউটার, সিপিইউ, মনিটর সবই আছাড় মেরে ভাঙা। ছিঁড়ে-কুটে নষ্ট করা হয়েছে ফাইল-খাতাপত্র।
দমদমের ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের এই তাণ্ডব-চিত্র তিন দিনে একটুও পাল্টায়নি। তারই মধ্যে, এক তলার বারান্দায়, কাচ বাঁচিয়ে অতি সাবধানে চলাফেরা করছেন এক মহিলা। শুভ্রা বিশ্বাস। ছাত্রী আবাসের ইনচার্জ। তিন সহকর্মীকে নিয়ে গত তিন দিন ধরে এই লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া স্কুলে রয়েছেন তিনি। বললেন, “যে ভাবে ভাঙচুর চালানো হয়েছে, দেখে মনে হচ্ছে যেন একটা যুদ্ধ হয়ে গিয়েছে!” |
গত বৃহস্পতিবার ভাঙচুরের পর থেকে স্কুলের অফিস ঘরের পাশে মোতায়েন করা হয়েছে জনা দশেক পুলিশ। শুভ্রাদেবী তাঁদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এই ভাঙা কাচ, আসবাবপত্র সরানো হচ্ছে না কেন? পুলিশকর্মীরা জানিয়েছেন, ভাঙচুরের সমস্ত প্রমাণ এ ভাবেই রাখতে হবে। ফরেন্সিক পরীক্ষার আগে সরানো যাবে না। শুভ্রাদেবী বললেন, “আমাকেও এ সব সরাতে নিষেধ করলেন পুলিশকর্মীরা। তাই এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দিয়েই চলাফেরা করতে হচ্ছে।” পানীয় জল পরিশ্রুত করার যন্ত্র ভাঙা। তাই খাওয়ার জলও আনতে হচ্ছে নীচের নলকূপ থেকে।
দোতলার বারান্দার এক দিকে অধ্যক্ষার ঘর। অন্য প্রান্তে ছাত্রী আবাস। আবাসের চত্বর খাঁ খাঁ করছে। শুভ্রাদেবী জানান, হস্টেলে ৩০ জন ছাত্রী থাকত। হামলার পরে হাতের কাছে থাকা জামাকাপড় এবং টুকিটাকি জিনিসপত্র নিয়ে হস্টেল ছেড়ে চলে গিয়েছে সবাই। স্কুলের মাঠের এক প্রান্তে দারোয়ান, গাড়ির চালক এবং সাফাই কর্মীদের থাকার ঘর। সেখানে দশ জন থাকতেন। ঘটনার পর আতঙ্কে অনেকে বাইরে চলে গিয়েছেন।
বৃহস্পতিবারের হামলায় স্কুলের কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা এখনও স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে স্পষ্ট নয়। তাঁদের বক্তব্য, স্কুলের অফিস এবং অধ্যক্ষার ঘরে ঢুকে অভিভাবক ও বহিরাগতরা আলমারির সব ফাইল, কাগজপত্র নষ্ট করে ফেলেছেন। আছড়ে ভেঙে ফেলেছেন অফিস ঘরের দু’টি এবং অধ্যক্ষার ঘরের একটি কম্পিউটার। ওই কম্পিউটারগুলিতে স্কুলের ছাত্রী ও শিক্ষিকাদের যাবতীয় তথ্য ছিল। ঘটনার পরের দিনই স্কুলের পরিচালন সমিতির লোকজন এবং চার্চ অফ নর্থ ইন্ডিয়ার (সিএনআই, স্কুলটি যে সংস্থার অধীন) কলকাতা ডায়োসেস-এর পক্ষ থেকে স্কুল পরিদর্শন করা হয়। তাঁরা ক্ষয়ক্ষতির একটি তালিকাও
তৈরি করেন। কলকাতা ডায়োসেস-এর সচিব আবির অধিকারী জানান, ওই স্কুলে মোট পড়ুয়ার সংখ্যা ২৮০০। তাদের যাবতীয় তথ্য, ইউনিট পরীক্ষার খাতা, ফলাফল, রেজিস্ট্রেশন ফর্ম সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এ দিনের তাণ্ডবে সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে উঁচু শ্রেণির ছাত্রীদের, বিশেষ করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়াদের। সিএনআই-এর কলকাতা ডায়োসেস সূত্রের খবর, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ অনুমোদিত এই স্কুলটি থেকে প্রতি বছরই দেড়শো থেকে দু’শো জন ছাত্রী মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেন। এ বছরও সংখ্যাটি অন্যান্য বছরের মতোই। কিন্তু ছাত্রীদের তালিকা, রেজিস্ট্রেশনের ফর্ম থেকে শুরু করে ইউনিট পরীক্ষার ফলাফল সবই ভাঙচুরে নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
তবে স্কুলের পক্ষ থেকে রবিবার জানানো হয়েছে, তাঁরা ছাত্রীদের স্বার্থে রাজ্যের স্কুল শিক্ষা দফতরের কাছে সব ধরনের সাহায্যের আবেদন জানাবেন। ছাত্রীদের যাতে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসতে অসুবিধা না হয়, তার ব্যবস্থা স্কুলের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সিএনআই-এর কলকাতা ডায়োসেস।
স্কুলের বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বেশ কিছু অভিভাবক ও ছাত্রী। অসহায় গলায় এক ছাত্রীর প্রশ্ন, “আমাদের প্রি-টেস্ট চলছিল। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষা শেষ হবে? এর পরেই তো টেস্ট! বলুন তো কী হবে?” |