বিরোধিতা করেছিল রাজ্য সরকার। তাতে অবশ্য দমদম ক্রাইস্ট চার্চ গার্লস স্কুলের অধ্যক্ষা হেলেন সরকারের জামিন আটকায়নি। চার রাত পুলিশি হেফাজতে থাকার পরে, সোমবার ব্যারাকপুর আদালতে অন্তর্বর্তী জামিন পেলেন তিনি। ৩০ সেপ্টেম্বর, পরবর্তী শুনানির দিন তাঁকে আবার হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।
জামিনের তিন শর্ত হল:
• মামলা উঠলে অভিযুক্তকে নিয়মিত হাজিরা দিতে হবে।
• তদন্তকারী অফিসারকে তদন্তে সাহায্য করতে হবে।
• কোনও তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করা চলবে না।
বৃহস্পতিবার ওই স্কুলে জনতার তাণ্ডবের পরে অধ্যক্ষা গ্রেফতার হন। শুক্রবার আদালত তাঁকে তিন দিন পুলিশি হাজতে রাখার নির্দেশ দেয়। সব মিলিয়ে তিন দিন ও চার রাত হাজতবাসের পরে এ দিন মুক্তি পান হেলেনদেবী। কিন্তু সরকারি আইনজীবী তাঁর জামিনের বিরোধিতা করায় কৌঁসুলিদেরই একাংশ বিস্মিত। সরকারি আইনজীবী শঙ্করদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আদালতে বলেন, অধ্যক্ষা জামিন পেলে তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করতে পারেন। তাই তদন্তের স্বার্থে তাঁকে জেল-হাজতে রাখা দরকার। আইনজীবীদের একাংশের প্রশ্ন, খোদ মুখ্যমন্ত্রী যখন আর্চবিশপকে ফোন করে ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করছেন, সেই সময় সরকারি আইনজীবী জামিনের বিরোধিতা করলেন কেন?
সরকারি আইনজীবী শঙ্করবাবু পরে বলেন, “আমরা মনে করি, তদন্তের স্বার্থেই অভিযুক্ত অধ্যক্ষাকে জেলে রাখা দরকার ছিল। সেই জন্যই জামিনের বিরোধিতা করেছি।”
আদালত অবশ্য হেলেনদেবীর জামিনের পক্ষে জোরালো যুক্তি দেখিয়েছে। ব্যারাকপুরের মহকুমা আদালতের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট পরাগ নিয়োগী তাঁর নির্দেশনামায় জানান, ‘পুলিশি তদন্তে তেমন অগ্রগতি হয়নি। তা ছাড়া অভিযুক্ত কোনও দাগি আসামি নন। তাঁর পালিয়ে যাওয়ার কোনও আশঙ্কাও নেই। এমনকী তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশের আনা ৩০৬ (আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া) ধারাও প্রযোজ্য নয়। তাই তাঁকে শর্তসাপেক্ষে অন্তর্বর্তী জামিন দেওয়া হল।’’
হেলেনদেবীর জামিন হবে কি না, তা নিয়ে সকাল থেকেই আদালত-চত্বরে আইনজীবীদের মধ্যে কানাঘুষো চলছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ায় হেলেনদেবীর জামিন পেতে আর অসুবিধা হবে না বলে মনে করেছিলেন বেশির ভাগ আইনজীবীই। বিষয়টি নিয়ে আগ্রহ ছিল সাধারণ মানুষেরও। সকাল থেকেই বহু মানুষ ভিড় করেন আদালতে। অনেকেই এসেছিলেন দমদম থেকে। বেলা ২টোর আগেই ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে তিলধারণের জায়গা ছিল না। ভ্যাপসা গরমে বারবার ঘাম মুছতে দেখা যায় পুলিশকর্মী এবং আইনজীবীদেরও।
বেলা ২টো ১০ মিনিটে পুলিশি প্রহরায় হেলেনদেবীকে আদালত কক্ষে আনা হয়। তাঁর পরনে ছিল সোনালি পাড়ের নকশা কাটা পেঁয়াজ রঙের তাঁতের শাড়ি। হনহন করে হেঁটে তিনি সোজা চলে যান আদালতের লক-আপের দরজায়। নিজেই সেখানে ঢুকে লোহার জালে হাত রেখে দাঁড়ান। সওয়া ২টো নাগাদ বিচারক এজলাসে আসেন। মামলাটি উঠতেই বিচারকের কাছে হেলেনদেবীর জামিনের আবেদন জানান তাঁর আইনজীবী সুভাষরঞ্জন দত্ত। সরকার পক্ষের আইনজীবী শঙ্করদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তার বিরোধিতা করেন। দু’পক্ষের বক্তব্য শুনে জামিন মঞ্জুর করেন বিচারক।
হেলেনদেবীর আইনজীবী সুভাষবাবু পরে আদালতের বাইরে বলেন, “অধ্যক্ষার বিরুদ্ধে কোনও মামলাই হয় না। মৃত ছাত্রী ঐন্দ্রিলা দাসের দাদু যে-এফআইআর করেছেন, তাতে হেলেনদেবীর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই। অধ্যক্ষাকে আটকে রেখে কোনও লাভ হবে না। তাই আদালতের এই সিদ্ধান্তই ঠিক।”
বিচারক জামিন মঞ্জুর করার পরেই পুলিশ হেলেনদেবীকে কোর্ট লক-আপ থেকে বাইরে এনে আদালত-চত্বরে নিজেদের লক-আপে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ঘনঘন জ্বলতে থাকে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। হতচকিত হয়ে পড়েন হেলেনদেবী। শেষ পর্যন্ত পুরুষ ও মহিলা পুলিশকর্মীরা তাঁকে ঘিরে ধরে নিয়ে যান পুলিশের লক-আপে। জামিনদারের সই করা পাঁচ হাজার টাকার বন্ড এবং আদালতের নির্দেশের প্রতিলিপি দিয়ে অধ্যক্ষাকে মুক্ত করেন আইনজীবীরা। একটু পরে একটি গাড়ি এসে দাঁড়ায় লক-আপের দরজায়। তাতে উঠে পড়েন অধ্যক্ষা। মুহূর্তের মধ্যে গাড়িটি আদালত-চত্বর থেকে বেরিয়ে যায়।
রাতেও সংবাদমাধ্যমের সামনে আসেননি হেলেনদেবী। তাঁর ভাই অভিজিৎ সরকার বলেন, “দিদি ছাড়া পাওয়ায় স্বস্তি পেলাম। দিদি মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছেন। মেয়েকে নিয়ে দিদি যাতে নিরিবিলিতে বিশ্রাম নিতে পারেন, তার চেষ্টা করছি।” অভিজিৎবাবু জানান, হেলেনদেবী তাঁকে বলেছেন, স্কুলের কোনও ছাত্রী যাতে এই ঘটনায় শাস্তি না-পায়, সেটাও সবাইকে দেখতে হবে।
|