কী করবেন পরাজিত নায়ক, নজর সে দিকেই
কেশুভাই পটেল তখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। দলের একঝাঁক বিধায়ক তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন। দাবি উঠল, নরেন্দ্র মোদীকে মুখ্যমন্ত্রী করতে হবে। মোদী তখন অশোক রোডে বিজেপির সদর কার্যালয়ের পিছনের ব্যারাকে থাকতেন। সে সময় অটলবিহারী বাজপেয়ী তাঁকে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী করার বিরোধী ছিলেন। কিন্তু মূলত লালকৃষ্ণ আডবাণীর আশীর্বাদ নিয়ে ২০০১ সালে প্রথম বার গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী পদে বসলেন নরেন্দ্র মোদী।
২০০২-এ গোধরা-পরবর্তী ঘটনার পরে ক্ষুব্ধ বাজপেয়ী মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে মোদীকে সরানোর কথা বলেছিলেন। সে দিনও মোদীকে সমর্থন করেছিলেন আডবাণীই।
১২ বছর পর ৮৫ বছরের লালকৃষ্ণ আডবাণীকে ব্রাত্য করে দিয়ে ৬২ বছরের নরেন্দ্র মোদী লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে দলের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হলেন। সঙ্ঘ পরিবারের আশীর্বাদ নিয়ে এ বার বিজেপির ‘লৌহপুরুষ’-কেই ইতিহাসে পরিণত করলেন একদা শিষ্য! বিক্ষুব্ধ, ব্যথিত, হতাশ এই সিন্ধি নেতাটি যেন এক বিয়োগান্তক নাটকের পরাজিত নায়ক।
রাজনীতির এ এক নির্মম পরিহাস!
আডবাণীর সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর সম্পর্কের অবনতি কিন্তু আকস্মিক নয়। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর ক্রমশ পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে এসেছেন মোদী। আর ক্যামেরার ভাষায় ‘ফেড আউট’ হয়ে গিয়েছেন আডবাণী। যখনই আডবাণী গুজরাতে যেতেন, মোদী আসতেন তাঁকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে। মুখ্যমন্ত্রিত্বের কয়েক বছর অতিবাহিত হওয়ার পরে আডবাণী হঠাৎ এক দিন বিমানবন্দরে অবতরণের সময় জানলা দিয়ে দেখলেন, তাঁকে স্বাগত জানাতে এসেছেন মোদীর অনুগামী রাজ্যের মন্ত্রী, হরেন পাণ্ড্য (যিনি এখন প্রয়াত)। মোদী সে দিন আসেননি। নিঃশব্দ এক পরিবর্তন। সে দিনের উপপ্রধানমন্ত্রী বুঝতে পেরেছিলেন, সময় বহতা স্রোত। শিষ্য এখন সাবালক!
কিন্তু এখন আডবাণী কী করবেন? তিনি আরও চিঠি লিখতে পারেন দলের সভাপতির কাছে। তিনি বিবৃতি দিয়ে মোদীর বিরোধিতা করতে পারেন। ব্লগে নিজের হতাশা ব্যক্ত করতে পারেন। কিন্তু দল ভেঙে নতুন দল গঠন করতে পারেন না। ভারতের রাজনৈতিক দলগুলির ভিতরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নতুন নয়। ই এম এস নাম্বুদিরিপাদকে সরিয়ে যখন হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ দলের কাণ্ডারী হয়েছিলেন, তখন ই এম এস খুব উচ্ছ্বসিত হতে পারেননি। আবার সুরজিতকে সরিয়ে প্রকাশ কারাট যখন দলের সাধারণ সম্পাদক হন, তখন তা মনে মনে মেনে নিতে পারেননি সীতারাম ইয়েচুরি। বিজেপিতেও অতীতে রাজনাথ সিংহ যখন সভাপতি হন, তখন অনেকেরই তা মনপসন্দ হয়নি। কিন্তু ভারতীয় দলতন্ত্রে নেতৃত্বের মূল স্রোত নির্ভর করে কর্মীদের সমর্থন কার দিকে, তার উপর। রাজ্য কমিটি থেকে কেন্দ্রীয় কমিটি, সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য কাউকে চাইলে কারও পক্ষেই তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রাজনীতি করা সহজ নয়।
বিক্ষুব্ধ রাজনীতিও নতুন নয়। কিন্তু বিজেপি, কংগ্রেস এমনকী সিপিএমের মতো দলেও বিক্ষুব্ধ রাজনীতি করে বহিষ্কৃত হলে পাল্টা দল গড়ে টিকে থাকা সহজ নয়। ত্রিপুরার নেতা নৃপেন চক্রবর্তীই হোন বা বাংলার সৈফুদ্দিন চৌধুরী, দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পরে তাঁরা প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছেন। কংগ্রেসে প্রণব মুখোপাধ্যায় বা অর্জুন সিংহরা পৃথক দল করেও ফিরে এসেছেন সেই কংগ্রেসেই। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ অল্প সময়ের জন্য সফল হয়েছিলেন। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি রাজনীতির আঙিনায় তাঁর দলও হারিয়ে গিয়েছে। তুলনামূলক ভাবে সফল হয়েছেন শরদ পওয়ার ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যে তাঁদের জনপ্রিয়তার জন্য। পওয়ারের বিদ্রোহ ছিল সনিয়া গাঁধীর বিরুদ্ধে। কিন্তু তাঁকেও আজ ইউপিএ-র শরিক হয়ে সনিয়া-মনমোহনের ছাতার তলায় থাকতে হচ্ছে। সীতারাম কেশরীকে সরিয়ে সনিয়া গাঁধীর সভানেত্রী হওয়ার ঘটনাও যথেষ্ট নাটকীয়। তবে প্রমোদ মহাজন একদা এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, “কংগ্রেসে গাঁধী পরিবারের প্রতি আনুগত্য নেতৃত্বের সঙ্কট ডেকে আনে না। তাকে আমরা পারিবারিক একনায়কতন্ত্র বলতে পারি। কিন্তু বিজেপিতে দলীয় গণতন্ত্র নেতাদের মধ্যে যে ক্ষমতার লড়াই সৃষ্টি করে, তাতে লাভের থেকে লোকসান বেশি।”
সে দিক থেকে দেখতে গেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক বিরল ব্যতিক্রম। আঞ্চলিক দলের নেত্রী হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেসকেই তিনি পশ্চিমবঙ্গে আসল কংগ্রেসে পরিণত করতে পেরেছেন। যে সোমেন মিত্র সাংগঠনিক নির্বাচনে মমতাকে হারিয়ে রাজ্য সভাপতি হয়েছিলেন, তিনি সে দিন কিছুতেই এই জনপ্রিয়তাকে মানতে চাননি। কিন্তু আজ সেই মমতার নেতৃত্বেই তিনি দলের লোকসভার সদস্য।
লালকৃষ্ণ আডবাণী দলের প্রবীণতম নেতা। কিন্তু বিজেপির শীর্ষ নেতারা প্রায় সকলেই মানছেন, দলের মধ্যে নরেন্দ্র মোদীই এখন জনপ্রিয়তম। মোদীর নাম ঘোষণায় দলের কর্মী-সমর্থকরা মনে প্রাণে খুশি। এই জনমতকে মূলধন করেই সঙ্ঘ পরিবার মোদীর নাম ঘোষণা করতে বিজেপিকে বাধ্য করেছে। তা ছাড়া যে আডবাণী সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্ন তুলে মোদীর সার্বিক গ্রহণযোগ্যতার কথা বলছেন, দলের অনেকেই আডবাণী সম্পর্কেও সেই একই অভিযোগ তুলছেন। তাঁদের বক্তব্য, বাজপেয়ী বিরোধিতা করা সত্ত্বেও অতীতে আডবাণীই তো ধর্মকে মূলধন করে রাজনীতি করেছেন। দলীয় কর্মীদের অনেকেরই মনে হচ্ছে, আডবাণী যেটা করছেন, যতটা মতাদর্শগত কারণে, তার থেকে বেশি ক্ষমতার রাজনীতির জন্য।
বাজপেয়ী এবং আডবাণী যখন দলের সর্বময় কর্তা ছিলেন, তখনও আরএসএসের নিয়ন্ত্রণ বিজেপির সরকারের উপরে কাজ করত। কে এস সুদর্শন এবং রজ্জু ভাইয়ার সঙ্গে নানা বিষয়ে বাজপেয়ী সরকারের সংঘাত হয়েছে। কিন্তু তখন বাজপেয়ী এবং আডবাণীর মতো নেতারা থাকায় তাঁরা সঙ্ঘকে যৌথ ভাবে সামাল দিতে পারতেন। একবার তো সাত নম্বর রেস কোর্স রোডের বৈঠকে সঙ্ঘ নেতাদের তাঁরা জানিয়েই দিয়েছিলেন, এনডিএ সরকারের প্রতিদিনের কার্যকলাপে নাক গলাবেন না।
জিন্না বিতর্কের পরে দলে আডবাণীর কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে যাওয়ায় সঙ্ঘের নিয়ন্ত্রণ অনেক বেড়ে গিয়েছে। নেতাদের অন্তর্দ্বন্দ্বের জন্য সঙ্ঘের উপর বিজেপির নির্ভরশীলতাও বেড়েছে। এই অবস্থায় আরএসএস চাইছে, মোদীকে সামনে রেখে আবার হিন্দুত্বের বিষয়টিকে পুনরুজ্জীবিত করতে। ক্ষমতায় আসা না আসা আরএসএসের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নয়। মোহন ভাগবতের মতাদর্শগত নির্দেশ, সরকার গঠনের লক্ষ্য ভুলে এখন হিন্দুত্বের লক্ষ্যে এগোতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে মোদী এবং আরএসএসের কৌশলগত বোঝাপড়া কী ভাবে অটুট থাকবে, সেটা দেখার। একই ভাবে দেখার, তিরিশ নম্বর পৃথ্বীরাজ রোডে বসে প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী কী করেন! চুপ করে বসে বলিউডের ছবি দেখার লোক কিন্তু তিনি নন।

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.