‘মোক্ষম শিক্ষা’য় এখনও আচ্ছন্ন সেই অসুস্থ শিক্ষিকা
প্রথম বার ওই ফ্ল্যাটের বেল বাজিয়েছিলাম শনিবার দুপুর আড়াইটে নাগাদ। দরজা খুলতেই জানতে চাইলাম, “সুস্মিতা হালদার আছেন?” জবাব এল, “উনি অসুস্থ, ঘুমোচ্ছেন।” ফের গেলাম বিকেল পাঁচটার পরে। তখনও একই জবাব। বিস্মিত হয়েই প্রশ্ন করি, “এখনও ঘুমোচ্ছেন? এক বার ওঁকে ডাকা যাবে না?’’ কয়েক মুহূর্ত চুপ। তার পরে কোল্যাপসিবল গেট খুলে ভিতরে ডেকে নিলেন দেবাশিস হালদার। ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের ভূগোলের শিক্ষিকা সুস্মিতাদেবীর স্বামী। বললেন, “বিশ্বাস না হলে ঘরের ভিতরে এসে দেখে যান, এখন কী অবস্থা ওঁর।”
ড্রইং-ডাইনিং রুম পেরিয়ে সোজা বেড রুম। ঘরের দরজা ভেজানো। ভিতরে অন্ধকার। এসি চলছে। আলো জ্বালিয়ে দিলেন দেবাশিসবাবু। খাটে শুয়ে রয়েছেন তিনি, যাঁকে বৃহস্পতিবার স্ট্রেচারে করে ক্রাইস্ট চার্চ স্কুল থেকে বাইরে এনে অ্যাম্বুল্যান্সে তোলা হয়েছিল। দেবাশিসবাবু বার কয়েক নাম ধরে ডাকলেন, কোনও সাড়া নেই। থুতনি ধরেও ডাকার চেষ্টা করলেন। কিন্তু প্রায় অচেতনের মতো ঘুমিয়ে রয়েছেন সুস্মিতাদেবী। দেবাশিসবাবু বললেন, “দেখছেন তো? এক বার ঘুমিয়ে পড়লে আর ওঠানো যাচ্ছে না। শুক্রবার রাত থেকে এ ভাবেই চলছে। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়াও করছে না।”
স্কুলে সে দিন অসুস্থ হয়ে পড়ার পরে স্ট্রেচারে শুইয়ে বার করে আনা হচ্ছে সুস্মিতাদেবীকে। —ফাইল চিত্র।
খাওয়ার ঘরের টেবিলে ঢাকা পড়ে রয়েছে ভাত, ডাল, তরকারি, অর্ধেক খাওয়া ডিম। সুস্মিতাদেবীর মা সে সব দেখিয়ে বললেন, “দুপুরে জোর করে কয়েক গ্রাস খাওয়ানো হয়েছিল। তার পরে আর পারেনি। ঘুমিয়ে পড়েছে।”
বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটে নাগাদ স্কুল থেকে স্বামীর মোবাইলে ফোন করেছিলেন সুস্মিতা। বলেছিলেন, “তুমি এখনই এসে আমাকে নিয়ে যাও। প্রচণ্ড গোলমাল চলছে। আমরা শিক্ষিকরা একটা ঘরে লুকিয়ে রয়েছি। আমার শরীর খুব খারাপ লাগছে।” দেবাশিসবাবু জানান, সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্কুলের দিকে রওনা হন। পৌঁছে দেখেন, সামনে বিশাল ভিড়। ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। স্ত্রীর শরীর খারাপের কথা জানিয়ে কোনও মতে ভিতরে ঢোকেন তিনি। দোতলার যে ঘরে শিক্ষিকারা ছিলেন, সেখান পৌঁছে দেখেন মেঝেতে শুয়ে রয়েছেন সুস্মিতা। তাঁর সহকর্মীরা জানান, সুস্মিতা হঠাত্‌ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অবিলম্বে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। মোবাইলে নাগেরবাজারের এক বেসরকারি হাসপাতালে ফোন করে অ্যাম্বুল্যান্স পাঠাতে বলেন দেবাশিসবাবু।
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে বেশ কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা হয়। দেবাশিসবাবু বলেন, “ডাক্তারেরা জানিয়েছেন, স্নায়ুর উপরে প্রচণ্ড চাপ পড়েছে। উদ্বেগ কমানোর ওষুধ দিয়েছেন। সঙ্গে ঘুমের ওষুধও। দিন সাতেক এ ভাবেই ঘুমোবে।”
ভূগোলের শিক্ষিকা সুস্মিতা কেমন আছেন জানতে চেয়ে তার সহকর্মী ও ছাত্রীরা বারংবার ফোন করছেন। স্ত্রীর মোবাইল ফোনটা তাই বন্ধ রেখেছেন দেবাশিসবাবু। “ওই দিনের ঘটনা নিয়ে ও এখন কোনও আলোচনা করুক, আমি সেটা চাই না। ওঁর কী দোষ বলুন তো? অধ্যক্ষাকে দিয়ে যে ভাবে ক্ষমা চাওয়ানো হল, যেন উনি খুন করেছেন। সত্যিই কি এই ব্যবহার ওঁদের প্রাপ্য? যাঁরা জানলার গ্রিল বাঁকিয়ে ভিতরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন, তাঁরা কি সত্যিই কারও অভিভাবক?”
ওই ফ্ল্যাট থেকে ক্রাইস্ট চার্চ স্কুল হাঁটা পথে মিনিট দশেক। বেশির ভাগ দিন হেঁটেই স্কুলে যেতেন সুস্মিতা। সে দিনও তাই গিয়েছিলেন। দেবাশিসবাবু বললেন, “ও আমাকে জানিয়েছে, স্কুলে ঢোকার মুখে কয়েক জন ছাত্রী ওকে সাবধান করে দিয়ে বলেছিল, দিদি ঢুকবেন না। ও বলল, সেটা শুনেও ওর কিছু মনে হয়নি। বরং ভেবেছিল, নিজেদেরই তো স্কুল। সেখানে ঢুকতে ভয় পাব কেন? মোক্ষম শিক্ষাটা পেল সে জন্য।”
আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব...
আলোকশিখায় শোক ও প্রতিবাদ। ছাত্রীর মৃত্যুতে শোক এবং স্কুলে ভাঙচুর ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির বিরুদ্ধে
প্রতিবাদ জানাতে দমদমের ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের পড়ুয়াদের সঙ্গে মোমবাতি-মিছিলে পা মেলালেন
সেখানকার প্রাক্তনীরাও। শনিবার। ছবি: শৌভিক দে।
ঘণ্টা দেড়েক কেটে গিয়েছে। বসার ঘরে সুস্মিতার স্বামী ও মায়ের সঙ্গে কথা বলছি। তখনও একই ভাবে ঘুমোচ্ছেন তিনি। সুস্মিতার মা বললেন, “আমার মেয়েটা বরাবরই খুব শান্ত। কাঁদতে কাঁদতে কাল আমাকে বলছিল, ওই গণ্ডগোলের সময়ে ওঁরা যখন স্কুলের একটা ঘরে লুকিয়ে রয়েছে, তখন বাইরে কোনও কোনও অভিভাবক বলছেন, ‘একটা টিচারকেও ছাড়ব না। বাইরে বেরোক এক বার। হাতে থালা ধরিয়ে রাস্তায় বসিয়ে দেব।’ শিক্ষকতা করতে এসে এটা বোধহয় ওঁদের প্রাপ্য ছিল না।”
ঘরের মধ্যে সবাই তখন চুপ। শুধু সুস্মিতার পাঁচ বছরের ছেলে দেবস্মিত এ দিক-ও দিক ছুটে বেড়াচ্ছে আর মুখ দিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সের সাইরেনের মতো শব্দ করছে। এ রকম করছে কেন? প্রশ্ন করতেই দেবাশিসবাবু বললেন, “সে দিন ওর মাকে অ্যাম্বুল্যান্সে নিয়ে যেতে দেখার পর থেকেই সারা দিন অ্যাম্বুল্যান্স-অ্যাম্বুল্যান্স খেলছে। যে কোনও গাড়ি দেখলেই বলছে, ওই দ্যাখো অ্যাম্বুল্যান্স যাচ্ছে, ওর ভিতরে আমার মা শুয়ে রয়েছে। মা-র খুব মন খারাপ তো, তাই!”

পুরনো খবর:
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.