|
|
|
|
দুই অভিভাবক ধৃত, জালে এক বহিরাগতও |
দেবজিৎ ভট্টাচার্য |
উপরমহলের নির্দেশ ছিল, বুঝিয়ে-সুজিয়েই শান্ত করতে হবে উন্মত্ত জনতাকে। তাই বৃহস্পতিবার ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলে ভাঙচুরের সময়ে আগাগোড়া হাত গুটিয়েই দাঁড়িয়ে ছিল পুলিশ। ৪৮ ঘণ্টা পরে সেই উপরমহলেরই নির্দেশে সক্রিয় হল তারা। শুরু হল ধরপাকড়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে খবরের কাগজে প্রকাশিত ছবি ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমের ফুটেজের উপরে ভরসা করেই এগোচ্ছে পুলিশ।
ভাঙচুরের অভিযোগে শনিবার তিন জনকে গ্রেফতার করেছে ব্যারাকপুর কমিশনারেট। তাঁদের নাম গোলাম মহম্মদ, ধীরেন রাজবংশী ও বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী। প্রথম দু’জনের মেয়ে ওই স্কুলের ছাত্রী হলেও তৃতীয় জন বহিরাগত। ধৃতদের ব্যারাকপুর আদালতে তোলা হলে তিন দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেন বিচারক। পুলিশ জানায়, ছবি দেখেই এ দিন সাত অভিভাবিকার বাড়িতে হানা দেওয়া হলেও কাউকে পাওয়া যায়নি। দরজায় তালা ঝুলছিল।
কেন সংবাদমাধ্যমের সাহায্য নিতে হচ্ছে পুলিশকে? প্রশ্ন উঠেছে, যখন সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত স্কুলে লাগাতার তাণ্ডব চালালেন অভিভাবকদের একাংশ, তখন পুলিশ কেন কারও ছবি তুলে রাখেনি? রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “বিক্ষোভে সামিল লোকজনকে পরবর্তী কালে চিহ্নিত করতে জেলা পুলিশ তো বটেই, থানাগুলিকেও ভিডিও ক্যামেরা কিনতে বলা হয়েছিল অনেক দিন আগে। কিন্তু সে দিন পুলিশের কাছে কোনও ক্যামেরা না থাকায় বাধ্য হয়ে সংবাদমাধ্যমের উপরে ভরসা করতে হচ্ছে।”
শুধু তা-ই নয়, স্কুলের আসবাবপত্র ভাঙচুর ও নথিপত্র ছেঁড়াছেঁড়ির পরে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে যে মামলা করেছিল দমদম থানার পুলিশ, তাতেও কারও নাম দেয়নি তারা। রাজ্য প্রশাসনের একাংশের মতে, পাড়ায় গিয়ে অভিযুক্তদের নামধাম জোগাড় করা পুলিশের কাছে খুব কঠিন কাজ নয়। দু’দিনেও কেন হামলাকারীদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জোগাড় করা গেল না, সেটাই বিস্ময়ের। |
|
ক্রাইস্ট চার্চে তাণ্ডব চালানোর অভিযোগে ধরা পড়ল ধীরেন রাজবংশী
(বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়), গোলাম মহম্মদ (বাঁ দিক থেকে তৃতীয়),
ও বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী (পিছনে)। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়। |
এ দিন মহাকরণে রাজ্যের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে পুলিশকর্তাদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠকেও ওঠে ক্রাইস্ট চার্চ প্রসঙ্গ। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা জানান, সে দিন যাঁরা হামলা চালিয়েছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কড়া আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। পুলিশকে তিনি বলেছেন, হামলাকারীদের অনেকেরই ছবি টেলিভিশনে দেখা গিয়েছে, সংবাদপত্রেও ছাপা হয়েছে। সেই সব ছবি ধরে ধরে সকলকে অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে। যাঁদের ছবি বেরোয়নি অথচ ভাঙচুরে হাত লাগিয়েছিলেন, তাঁদেরও খুঁজে বার করতে হবে।
তবে সে দিনের পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশ যে কার্যত ব্যর্থ, তা ঠারেঠোরে মেনে নিয়েছেন রাজ্যের পুলিশকর্তাদেরই একাংশ। কেন? সব স্তরের পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, জেলার গোয়েন্দাদের কাছে প্রাথমিক খবর ছিল, মৃত ছাত্রী ঐন্দ্রিলা দাসের বাড়ি যেখানে, সেই এলাকার কিছু অভিভাবক প্রতিবাদ জানাতে স্কুলের সামনে জড়ো হতে পারেন।
সেই মতো একটু বেলার দিকে হাতে গোনা পুলিশ পাঠানো হয়েছিল সেখানে। কিন্তু বিক্ষোভে যে মহিলারাই বেশি সক্রিয় ভূমিকা নেবেন, তা বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারেনি পুলিশ। পরে যখন মহিলা পুলিশ পাঠানো
হয়, পরিস্থিতি তখন যথেষ্টই ঘোরালো। কমিশনারেটের এক পুলিশকর্তা বলেন, “বেলা বাড়তেই অভিভাবকদের ভিড় স্কুলের গেটে আছড়ে পড়তে শুরু করে। যোগ দেয় বহু বহিরাগতও। এত দ্রুত তারা জড়ো হয়ে যায় যে লাঠি হাতে পুলিশ হতচকিত হয়ে পড়ে।”
সেটাই পরে আতঙ্কে পরিণত হয়। সে দিন স্কুলে ডিউটি করেছিলেন, এমন একাধিক পুলিশকর্মী বলেন, “অধ্যক্ষা ও শিক্ষিকাদের না পেয়ে আমাদেরই অশ্রাব্য গালিগালাজ করে বিক্ষোভকারীরা। ইউনিফর্ম ধরে টানাটানি করে। হাতে রড-লাঠি নিয়ে মাঝেমধ্যেই তেড়ে আসছিল আমাদের দিকে।” এতেই নিচুতলার পুলিশকর্মীদের ধৈর্যের বাঁধ একটু একটু করে ভাঙতে শুরু করে। ওই পুলিশকর্মীরা বলেন, “আমরা বারবার সাহেবদের (পুলিশকর্তা) কাছে নিদেনপক্ষে লাঠি উঁচিয়ে জনতাকে সরানোর অনুমতি চেয়েছিলাম। কিন্তু তা না মেলায় আমরা এক সময় কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলাম।”
একটি সূত্র জানাচ্ছে, পুলিশকর্মীদের মনোভাব বুঝে এর পরে কড়া পদক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত হয়। সেই মতো চটজলদি এক গাড়ি র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্সও (র্যাফ) পাঠিয়ে দেওয়া হয় দমদমে। কিন্তু তাদেরও দাঁড় করিয়ে রাখা হয় বলে অভিযোগ। রাজ্যের এক পুলিশকর্তা বলেন, “খুব দ্রুত ভিড় হালকা করার প্রশিক্ষণই দেওয়া হয় র্যাফকে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাজ হাসিল করে ফেলে তারা। তাই ওদের বসিয়ে রাখা হয় না। কিন্তু দমদমে র্যাফ-ও ‘অ্যাকশন’ নেওয়ার অনুমতি পায়নি।”
কেন? সূত্রের দাবি, র্যাফ পাঠানোর আগেই গোটা ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে মহাকরণের দ্বারস্থ হয়েছিলেন কমিশনারেটের পুলিশকর্তারা। বিভিন্ন চ্যানেলেও তখন ওই একটাই খবর। কিন্তু তাঁদের বলা হয়, উপরমহলের নির্দেশ, বিক্ষোভকারীদের উপরে লাঠি চালানো যাবে না। বুঝিয়ে-সুজিয়েই তাঁদের বাড়ি পাঠাতে হবে। দফায় দফায় সেই বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয় দমদমে। এক পুলিশকর্তা বলেন, “ওই বার্তা পেয়ে পুলিশ আরও কুঁকড়ে যায়। কমিশনারেটের ডিসি-ডিডি হাত জোড় করে মাইক নিয়ে জনতাকে শান্ত হওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু সে কথা কানে তোলেননি বিক্ষোভকারীরা। অধ্যক্ষা হেলেন সরকারকে গ্রেফতার ও তাঁর পদত্যাগের দাবিতে তখনও অনড় অভিভাবকদের একাংশ। |
আমি হতাশ। বাবা-মায়েরাই যদি শৃঙ্খলা না মানেন, তা হলে ছেলেমেয়েদের থেকে আর কীইবা আশা করা যায়!
এম কে নারায়ণন, রাজ্যপাল |
|
শেষে অধ্যক্ষাকে গ্রেফতারে নিরসন ঘটে দিনভর বিক্ষোভের। কিন্তু তাতেও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটেনি। রাজ্য প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য, বুধবার রাতে যখন মৃতার বাবা দমদম থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছিলেন, তার পরেই অধ্যক্ষাকে গ্রেফতার করা উচিত ছিল। তা হলে আর বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ দানা বাঁধত না। তাঁরা বলছেন, অধ্যক্ষার বিরুদ্ধে যে সব ধারায় মামলা করা হয়েছে, তা কখনওই কাঙ্ক্ষিত নয়। এতে সমাজে ভুল বার্তাই পৌঁছচ্ছে। পুলিশ কেন অধ্যক্ষাকে নিজেদের হেফাজতে চাইল, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন প্রশাসনের ওই অংশ।
পুলিশকর্তাদের একাংশের পাল্টা দাবি, অবৈধ ভাবে আটক, জবরদস্তি টাকা আদায় কিংবা ভয় দেখিয়ে বশে আনার মতো গুরুতর ধারা আনার পরে অভিযুক্তকে নিজেদের হেফাজতে নেওয়ার আবেদন করা ছাড়া বিকল্প কোনও পথ খোলা থাকে না। ওই ধারাগুলি অভিযুক্তের পুলিশি হেফাজতই দাবি করে।
পুলিশকর্তাদের সঙ্গে এ দিনের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য স্কুল-কাণ্ডে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে তেমন কিছুই বলেননি বলে মহাকরণের একটি সূত্রের দাবি। অন্য একটি সূত্র পাল্টা দাবি করেছে, পুলিশের কাজে অসন্তোষ প্রকাশ করে বৈঠকেই তিনি ডিজি-কে বলেন, তাঁকে ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে জানানো হয়নি। সমন্বয়ের অভাব ছিল। এ ঘটনা কিছুতেই বরদাস্ত করা যায় না। কোনও ভাবেই যাতে দোষীরা ছাড়া না পায়, সে ব্যাপারে পুলিশকে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। বৈঠকে দমদম প্রসঙ্গ উঠলেও ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনারকে মহাকরণে ডাকা হয়নি।
এ দিনের বৈঠকের কথা শুক্রবার রাতেই রাজ্য পুলিশের সর্বোচ্চ মহলকে জানানো হয়। বলা হয়েছিল, বৈঠকে ক্রাইস্ট চার্চ প্রসঙ্গ উঠবে। এর পরেই এফআইআরে থাকা অজ্ঞাতপরিচয় অভিযুক্তদের গ্রেফতার করার প্রস্তুতি শুরু করে ব্যারাকপুর কমিশনারেট। জেরা করা হয় স্কুলের সাফাইকর্মীকে। এক পুলিশকর্তা বলেন, “ঐন্দ্রিলার বাবা অভিযোগ করেছিলেন, তাঁর মেয়েকে শৌচাগারে আটকে রেখে ১০০ টাকা দাবি করা হয়েছিল। সাফাইকর্মীকে জেরা করারও অনুরোধ করেছিলেন তিনি।”
মহাকরণ সূত্রের খবর, পুলিশি জেরায় ওই সাফাইকর্মী বলেছেন, স্কুলে মোট ৩০টি শৌচাগার। তার মধ্যে ২৪টি ছাত্রীরা ব্যবহার করে। কিন্তু কোনও শৌচাগারের দরজাই বাইরে থেকে বন্ধ করা যায় না। সাফাইকর্মীর বক্তব্য যাচাই করার পাশাপাশি ওই ঘটনার পরে স্কুলের শৌচাগারের দরজায় কোনও অদল-বদল হয়েছে কি না, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে ফরেন্সিক পরীক্ষারও আর্জি জানিয়েছে পুলিশ।
|
পুরনো খবর: গোড়ায় বোঝেনি পুলিশ, বিক্ষোভ বেসামাল তাতেই |
মৃত্যু-তদন্তের কী হবে, প্রশ্ন বাবার
নিজস্ব সংবাদদাতা |
শনিবার স্কুলের সামনে জমায়েত করে ছাত্রী-অভিভাবক ও প্রাক্তনীরা যখন দ্রুত স্কুল খোলা, অধ্যক্ষার মুক্তি এবং ভাঙচুরে দোষীদের শাস্তির দাবি করছিলেন, তখন ঐন্দ্রিলার বাবা শান্তনু দাস প্রশ্ন তুললেন, “কিন্তু আমার মেয়ের মৃত্যুর তদন্ত কি এতটুকুও এগিয়েছে?” এ দিনও তিনি আরও এক বার দাবি করেছেন, ঐন্দ্রিলাকে হেনস্থার অভিযোগ রয়েছে যে ছাত্রীদের নামে, তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হোক। এ দিন বিকেলে প্রাক্তনীদের উদ্যোগে হাজার দেড়েক ছাত্রী মিছিল করে ঐন্দ্রিলার বাড়িতে যায়। স্কুল গেটের জমায়েত থেকেই ছাত্রী ও অভিভাবকরা মিছিলে হাঁটতে থাকেন। প্রায় চার কিলোমিটার পথ হেঁটে বাগুইআটির ঘোষপাড়ায় ঐন্দ্রিলার বাড়িতে পৌঁছন তাঁরা। মিছিলে পা মেলান আশেপাশের বহু মানুষও। ছাত্রীরা ঐন্দ্রিলার বাবা ও মায়ের সঙ্গে দেখা করেন। ঐন্দ্রিলার ছবিতে সবাই মালা দেন, মোমবাতিও জ্বালান। ঐন্দ্রিলার মা ওই ছাত্রীদের কাছে টেনে নিয়ে বলেন, “তোরা ঐন্দ্রিলাকে ভুলে যাবি না তো! দেখিস, স্কুলে যেন আর ভাঙচুর না হয়।” |
|
|
|
|
|