মেয়েদের স্কুল। শিক্ষিকারাও সবাই মহিলা। স্কুলের সামনে উপস্থিত অভিভাবকদের মধ্যে মহিলারাই সংখ্যাগুরু। অথচ, মহিলা পুলিশকর্মীদের মোতায়েন করা হয়নি। আর স্কুলের গেটের বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যে ক’জন পুরুষ পুলিশকর্মী ছিলেন, তাঁদের সংখ্যা ছিল নগণ্য। আর সেই সুযোগটা নিয়েই বৃহস্পতিবার ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হল দমদমের ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলে।
ঐন্দ্রিলার মৃত্যুর জেরে ক্ষোভ দানা বেঁধেছিল বুধবারেই। বৃহস্পতিবার স্কুল বন্ধ থাকা সত্ত্বেও অভিভাবকেরা স্কুলের সামনে জড়ো হয়েছিলেন দলে দলে। শুধু পুলিশই পরিস্থিতি আঁচ করতে পারেনি। তাই জনা দশেক পুলিশকর্মী ছাড়া বেলা ১১টা পর্যন্ত স্কুল চত্বরে দেখা যায়নি পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ। সেই সুযোগটাই এক শ্রেণির বিক্ষোভকারী নিয়েছিলেন বলে ধারণা পুলিশকর্তাদের একাংশের।
তাঁরা বলছেন, অভিভাকদের সঙ্গে বাইরের কিছু লোক ঢুকে পড়ে যখন স্কুলে ভাঙচুর শুরু করে, তখন তাদের সামালই দিতে পারেনি ওই সামান্য পুলিশবাহিনী। প্রমীলা বাহিনী পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙেই ঢুকে যায় অধ্যক্ষার ঘরে। স্কুলের ভিতরে সর্বত্র যখন ভাঙচুর চলছে, অধ্যক্ষা ও অন্য শিক্ষিকাদের যখন একটি ঘরে আটকে রাখা হয়েছে, সেই ঘরের জানলার লোহার শিক কেউ কেউ ভাঙার চেষ্টা করছে তখন পুলিশবাহিনীর ভূমিকা ছিল স্রেফ দর্শকের। দুপুরের পরে যখন বেশি সংখ্যায় মহিলা পুলিশ, র্যাফ, ব্যারাকপুর কমিশনারেটের কর্তাদের ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়, তখন পরিস্থিতি অনেকটাই আয়ত্তের বাইরে। |
ব্যারাকপুর কমিশনারেটের এক পদস্থ কর্তার মন্তব্য, “অভিভাবকদের ক্ষোভের আঁচ আমাদের আগেই পাওয়া উচিত ছিল। মৃতা ছাত্রীর অভিভাবকেরা থানায় অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে গাফিলতির নির্দিষ্ট অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। এর থেকেই আমাদের বোঝা উচিত ছিল, এ দিন স্কুলে বিক্ষোভ হতে পারে।” ওই কর্তা বলেন, “অভিভাকদের সঙ্গে বহিরাগত বেশ কিছু লোক ঢুকে পড়েছিল স্কুলে। তারাই জানলার শিক ভেঙেছে, ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়েছে।” পুলিশ কেন ওই বহিরাগতদের আটকাল না? ওই পুলিশকর্তার বক্তব্য, “অধ্যক্ষ ও অন্য শিক্ষিকারা যে ঘরে ছিলেন, তার দরজার সামনে থেকে কোনও পুলিশকর্মীর পক্ষেই সরে আসার উপায় ছিল না।”
সকালে ঘটনাস্থলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ভার যাঁদের উপরে ন্যস্ত ছিল, তাঁদের অবশ্য দাবি, সকাল ন’টা নাগাদ দমদম থানা থেকে দু’ভ্যান পুলিশ ঘটনাস্থলে ছিল। আইসি নিজেও ছিলেন। ১০টার পরে অভিভাবক ও বহিরাগতদের ভিড় বাড়তে থাকায় বেলঘরিয়ার এডিসি এবং ডিসি ডিডি-কে বিষয়টি জানানো হয়। এর পরেই এক এক করে নিমতা, বেলঘরিয়া ও বরাহনগর থানা থেকে আইসি-রা বাহিনী নিয়ে যান। ততক্ষণে স্কুলের দখল নিয়েছে জনতা। পৌনে ১২টা নাগাদ বেলঘরিয়ার এসিপি (২) মহম্মদ নাসিম ৪০ জন র্যাফের একটি বাহিনী নিয়ে পৌঁছন। ১২টা নাগাদ এডিসি (বেলঘরিয়া) ইমার্জেন্সি ফোর্স লাইন থেকে কমব্যাট ফোর্স ও পিটিসি থেকে মহিলা পুলিশের একটি বাহিনী নিয়ে পৌঁছন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেট থেকে আসে জলকামানও। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা ছাড়া পুলিশের কিছু করার ছিল না। মাইকে বারবার জনতাকে শান্ত থাকার অনুরোধ করতে থাকেন পুলিশকর্তারা। কাজ হয়নি।
বিকেল ৩টে নাগাদ ঘটনাস্থলে পৌঁছন ব্যারাকপুরের গোয়েন্দা প্রধান দেবাশিস বেজ। পুলিশ স্কুলের মধ্যে শিক্ষিকাদের সঙ্গে থাকলেও বাইরে তখন প্রবল উত্তেজনা। অধ্যক্ষা পদত্যাগপত্র দিলে গোয়েন্দাপ্রধান তা জনতার সামনে পড়ে শোনান। তার পরে কার্যত পরিস্থিতি একটু শান্ত হয়। কিন্তু অধ্যক্ষাকে গ্রেফতারের দাবিতে অনড় থাকেন অভিভাবকেরা।
এক পুলিশকর্তার মন্তব্য, “অভিভাবকদের কাউকেই এ দিন স্কুলের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া উচিত হয়নি। প্রথম থেকে পুলিশ গেট আটকাতে পারলে এমন ঘটত না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য রাত ৯টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত না।” দেবাশিসবাবুর ব্যাখ্যা, “বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় আমরা অভিভাবকদের বুঝিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। আর প্রথম দিকে মহিলা পুলিশের সংখ্যাও কম ছিল। আমরা মাইকে ঘোষণা করেও জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিলাম। তখন কোনও কড়া ব্যবস্থা নিলে হিতে বিপরীত হত।”
রাত ৯টা নাগাদ স্কুলের অধ্যক্ষা হেলেন সরকারকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা করা হয়েছে। পুলিশকর্তারা জানাচ্ছেন, অবৈধ ভাবে আটকে রাখা, ইচ্ছাকৃত ভাবে আঘাত করা, জোর খাটিয়ে তোলা আদায় করার মতো অভিযোগ আনা হয়েছে অধ্যক্ষার বিরুদ্ধে। মৃতা ছাত্রীর অভিভাবকেরা তাঁর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ করেছিলেন। অধ্যক্ষাকে গ্রেফতার করলেও স্কুলে ভাঙচুরের ঘটনায় কেউ গ্রেফতার হল না কেন? রাতে ব্যারাকপুরের কমিশনার বিশাল গর্গ বলেন, “সবই তদন্ত হবে। ঘটনাস্থলে যে সব পুলিশ আধিকারিক ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করব। ভাঙচুরের জন্য অজ্ঞাতপরিচয়দের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।” |