স্কুলের নীচে তখন রণক্ষেত্র। পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি চলছে কয়েকশো উন্মত্ত বিক্ষোভকারীর। দোতলায় হস্টেলের ঘরে বসে আতঙ্কে, ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে প্রায় জনা তিরিশ ছাত্রী। অনেকেই কাঁদছে। সকাল থেকে খাবার জোটেনি। ওদের কারও বয়স ১২, কারও ১০, কারও বা ৮। নীচে কী চলছে, কেউ জানে না। শুধু জানে, ম্যাডামদের মারধর করছে একদল লোক। হস্টেলের কর্মীরা ওই ছাত্রীদের শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তারা তখন বলছে, “বাড়ি যাব।”
বৃহস্পতিবার এই দৃশ্য দমদমের ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের। হস্টেল-কর্মীরা জানান, ঐন্দ্রিলার মৃত্যুর জন্য এ দিন স্কুল ছুটি ছিল। তাই একটু দেরিতেই ঘুম থেকে ওঠে ছাত্রীরা। কিন্তু গোলমালের জেরে তাদের সকালের জলখাবার তৈরি করা যায়নি। নীচ থেকে খাবার জলটুকু আনারও সাহস পাচ্ছিলেন না কর্মীরা। শেষে বেলা ১১টা নাগাদ পুলিশের সাহায্যে তাঁরা নীচ থেকে জল এনে বাচ্চাদের খাওয়ান। বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ বাইরে থেকে খাবার আনা সম্ভব হয়। তখন খাওয়ানো হয় ছাত্রীদের।
সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রী বলে, “এত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যে, সকাল থেকে জল পর্যন্ত খেতে পারিনি। একতলায় বাথরুমে যাওয়ার সাহসটুকুও হচ্ছিল না। মাসিরা আমাদের ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা দিয়ে রেখেছিল। যাতে কেউ উপরে উঠে আসতে না পারে। আমরা সবাই জড়োসড়ো হয়ে দরজা-জানলা বন্ধ করে বসেছিলাম। মাসিরা বলছিল, ভয় পাস না। সিঁড়িতে পুলিশ আছে। কেউ কিছু করবে না।” |
পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীর কথায়, “১১টা নাগাদ নীচ থেকে একটু জল এনে দেয় মাসিরা। কিছুক্ষণ পরে জানলা দিয়ে দেখি, এক জন একটা চেয়ার তুলে ছুড়ে মারল একতলার জানলায়। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল কাচ। চেয়ারটাও ভেঙে গেল। আর এক জন ইট মারল দরজায়। তখন খালি মনে হচ্ছিল, ওই ইট যদি আমাদের গায়ে এসে পড়ে, তা হলে কী হবে? আর মনে মনে ভাবছিলাম, এক বার উপরে উঠতে পারলে ওরা তো ঘর লন্ডভন্ড করে দেবে।”
হস্টেলের কর্মীরা ছাত্রীদের বাঁচাতে এর পরে দোতলার বারান্দার গ্রিলেও তালা লাগিয়ে দেন। তার পরে ওই ছাত্রীদের থেকে বাড়ির ফোন নম্বর নিয়ে তাদের অভিভাবকদের খবর পাঠাতে শুরু করেন। ছাত্রীদের ব্যাগপত্র গুছিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের ব্যাগও গোছাতে শুরু করেন। দুপুর ২টোর পর থেকে একে একে আসতে থাকেন অভিভাবকেরা। এক অভিভাবক বলেন, “সকালে শুনেছিলাম, স্কুলে খুব গোলমাল হচ্ছে। শুনে প্রথমে মনে হয়েছিল, হস্টেলের ছাত্রীরা নিরাপদেই আছে। কিন্তু ওদেরও যে প্রাণসংশয় হতে পারে, ভাবিনি।” সপ্তম শ্রেণির আর এক ছাত্রী বলে, “আমরা সবাই সারাদিন না খেয়ে। চুপ করে বসে ছিলাম। বাবা আসায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।” আর এক অভিভাবকও তাঁর মেয়ের হাত ধরে কোনওক্রমে স্কুল থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। হাতে এলোমেলো ভাবে গোছানো একটা জামাকাপড়ের ব্যাগ।
স্কুলের অধ্যক্ষা হেলেন সরকার যখন ক্ষমা চাইতে উপরে ওঠেন, তখন কয়েক জন বহিরাগতও উঠে আসে। কিন্তু গ্রিলের গেটে তালা থাকায় তারা ভিতরে ঢুকতে পারেনি। পুলিশ তাদের নামিয়ে দেয়। বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বাকি অভিভাবকেরাও তাঁদের সন্তানদের নিয়ে যান। সন্ধ্যায় দেখা যায়, হস্টেল ফাঁকা। আলো নেভাতে নেভাতে এক কর্মী বললেন, “হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বাচ্চাগুলোকে তো বাঁচাতে পেরেছি। সবাই যে নিরাপদে যেতে পেরেছে, সেটাই অনেক।” |