বিকেলে একটি বারের জন্য ফোনে ধরা গিয়েছিল তাকে। কিছু বলার সুযোগ না-দিয়েই বালিকার রিনরিনে স্বর তখন কেঁপে উঠল। “তুমি কি ক্রাইস্ট চার্চ থেকে বলছ? মা তোমার সঙ্গে আছে? মা কেন আসছে না? আমায় দাও না, এক বার মায়ের সঙ্গে কথা বলব...!”— এক নিঃশ্বাসে বলা কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই ফোনের ও-পারে ডুকরে কান্নায় ভেঙে পড়ার শব্দ!
ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের ধৃত অধ্যক্ষা হেলেন সরকারের মেয়ের কাছ থেকে এর পরেই তার মামা মোবাইলটা নিয়ে নিলেন। বললেন, “দেখছেন তো কী অবস্থা! এই জন্যই ওর সঙ্গে আমরা কাউকে কথা বলতে দিচ্ছি না!” ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের ঘটনার পর থেকে স্বাভাবিক ভাবেই তিতকুটে মেজাজে রয়েছেন হেলেনের ভাই অভিজিৎ সরকার। হেলেনকে বলির পাঁঠা করা হয়েছে বলেই মনে করছেন তাঁরা। ভাগ্নির মনের উপরে চাপ পড়বে ভেবেই তার সঙ্গে প্রথমটায় কথা বলতে দিতে চাইছিলেন না অভিজিৎবাবু। বাড়িতে গিয়ে দেখা করার অনুমতি মেলেনি। অনেক অনুরোধের পরে শনিবার বিকেলে এক বারই ফোনটা দিলেন ১১ বছরের ভাগ্নিকে। কিন্তু বেশি ক্ষণ কথা বলা গেল না।
দমদমের ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের আবাসনে ছোট্ট সংসারে হেলেন আর তাঁর মেয়েই শুধু থাকেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর এখনও পর্যন্ত এক বারই দু’জনের কথা হয়েছে। দু’জনেই হাউহাউ করে কেঁদেছেন। হেলেনের ভাই অভিজিৎবাবু (ঢাকুরিয়ায় যাঁর বাড়িতেই হেলেনের মেয়ে রয়েছে) এর পরেই সিদ্ধান্ত নেন, দু’জনকে আর ঘনঘন কথা বলানো যাবে না। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
শুক্রবার সকালে ব্যারাকপুর থানার ল্যান্ডলাইন থেকে মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ক্রাইস্ট চার্চের অধ্যক্ষা কাঁদতে কাঁদতে মেঝেয় বসে পড়েছিলেন। পুলিশকর্মীদের কয়েক জনেরও তখন বিহ্বল দশা! ফোনে মা-মেয়ের কথোপকথন বলতে ছিল প্রধানত মেয়েরই একতরফা উদ্বিগ্ন প্রশ্ন। “মা তুমি কোথায়? বাড়ি আসছো না কেন? স্কুলে কি এখনও মারামারি হচ্ছে? তুমি কি স্কুলে আটকে আছো? তোমাকে আসতে দিচ্ছে না ওরা? তুমি বাড়ি না এলে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি....” কথা শেষ করতে পারেনি মেয়ে। টেলিফোনের রিসিভারটা জড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিল।
মেয়ের সঙ্গে কথা বলার সময়ে ভেঙে পড়লেও হেলেন অবশ্য এখনও পর্যন্ত পুলিশের যাবতীয় প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন সংযত ভাবেই। পুলিশের দাবি, স্কুলে যা যা ঘটেছে বলে অভিযোগ, তার জন্য অধ্যক্ষা হিসেবে বারবার আক্ষেপ করলেও হেলেন ওই স্কুলে ফিরে যেতেই বদ্ধপরিকর। স্কুল পরিচালন কমিটির সম্পাদককে ইস্তফাপত্র দিলেও মনে-মনে এখনও স্কুলের সঙ্গেই জড়িয়ে আছেন তিনি। তাঁর ইস্তফাপত্র এখনও মঞ্জুর হয়নি। পুলিশকর্মীদের হেলেন বলেছেন, “যা ঘটেছে তাতে আমার বড় শিক্ষা হল। ঐন্দ্রিলাকে ফেরাতে পারব না। কিন্তু এই স্কুল আমার প্রাণ। প্রাণ থাকতে এই স্কুল ছেড়েও থাকতে পারব না।”
হেলেনের মেয়েকে নিয়ে তার মামা-মামির দুশ্চিন্তা অবশ্য ক্রমেই বাড়ছে। শহরের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের (ক্রাইস্ট চার্চ নয়)
ক্লাস ফাইভের পড়ুয়া ভাগ্নির মনটা অন্য দিকে ঘোরাতে চেষ্টা করছেন কার্টুন চ্যানেল খুলে দিয়ে। ফোনে অভিজিৎবাবুর গলায় অসহায়তা “কী করি বলুন তো? একেবারে ছোট বাচ্চা তো নয়! যা হয়েছে, তার অনেকটাই বুঝতে পারছে। ওকে খবরের কাগজ বা নিউজ চ্যানেল দেখতে দিতে পারছি না। টিভি-তে সিনেমা দেখেও ওর মনে কখন কী ছাপ পড়বে, ভেবে ভয়ে কাঁটা হয়ে আছি! সারা ক্ষণ মেয়েটাকে আগলে আগলে রাখতে হচ্ছে।”
এর মধ্যেও দিদির জন্য পুলিশি ঝুটঝামেলা সামলাতে অভিজিৎবাবু ও তাঁর স্ত্রীকে মাঝেমধ্যেই বেরোতে হচ্ছে। এই ক’দিনের আতঙ্ক কাটিয়ে ভাগ্নিকে কী ভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো যাবে, সেটা এখন তাঁদের বড় চিন্তা। মামা বললেন, “প্রথম দিকটায় আতঙ্কের চোটে ওর জ্বর এসে গিয়েছিল। এখন সেটা নেই। কিন্তু মেয়েটা থম মেরে গিয়েছে। সারা ক্ষণ কাঠ হয়ে বসে। পড়া, ছবি আঁকা কোনও কিছুতে মন বসাতে পারছে না। ফোন এলেই শুধু মায়ের খোঁজ করছে।” তাই তাকে পারতপক্ষে কোনও ফোন ধরতে দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু এই ভাবনাটাও থাকছে যে, এক দিন তো স্কুলে যেতেই হবে। সেখানে পাঁচ জনের কৌতূহলের মুখোমুখি হতে হবে ওকে। সেটা কী ভাবে সামলানো যাবে? মনোবিদের সাহায্য নেওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা।
ঢাকুরিয়ার ফ্ল্যাট আর ব্যারাকপুর থানার ঘরের মধ্যে তাই আপাতত তেমন ফারাক নেই। ব্যারাকপুর কমিশনারেটের গোয়েন্দাপ্রধান দেবাশিস বেজ বলেন, ‘‘অধ্যক্ষা অভিযুক্ত। কিন্তু অপরাধ প্রমাণ হয়নি। ওঁকে তাই একজন শিক্ষকের মর্যাদা দিয়েই রাখা হয়েছে।” পুলিশের দাবি, তাঁর মানসিক অবস্থা অশান্ত বলে সাবধানে জেরা করা হচ্ছে। পুলিশ সূত্রের খবর, হেলেন সময়মতো খাবার খাচ্ছেন। এক বারই মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। আর ঢাকুরিয়ার ফ্ল্যাটে হেলেনের মেয়েকে কার্টুন ছবি, টুকটাক হাসি-গল্পে ভুলিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তার মামা-মামি।
|