স্কুল খোলার দাবিতে একজোট সকলেই
ভাঙচুর চালিয়েছিলেন এক দল অভিভাবক ও বহিরাগত। তার চেয়ে ঢের বেশি সংখ্যক মানুষ শনিবার স্কুল খোলা এবং অধ্যক্ষকে ফিরিয়ে আনার দাবি তুললেন। সেই দলে যেমন ছিলেন বর্তমান ছাত্রী ও অভিভাবকেরা, তেমনই যোগ দেন প্রাক্তনীরাও। এ দিন স্কুলের গেটের সামনে অস্থায়ী মঞ্চ বেঁধে সভা করেন তাঁরা। স্কুল দ্রুত খোলার সঙ্গে তাঁরা দাবি তোলেন, অধ্যক্ষাকে ফিরিয়ে আনতে হবে এবং যাঁরা ভাঙচুর করেছেন, তাঁদের শাস্তি দিতে হবে। সেখানে একই সঙ্গে আরও একটা বিষয় স্পষ্ট করে দেওয়া হয় এই আন্দোলনে কোনও ভাবেই রাজনীতি ঢুকতে দেওয়া হবে না।
কিন্তু প্রশ্ন থেকেই গেল, স্কুল কবে খুলবে? রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু চান, দমদমের ক্রাইস্ট চার্চ স্কুল খুলুক আগামী কাল, সোমবার। তিনি জানান, সে জন্য বিভাগীয় সচিবকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। রাতারাতি তৈরি হওয়া অভিভাবক সমিতিও শিক্ষামন্ত্রীর কাছে একই দাবি জানানোর জন্য তৈরি হচ্ছেন। এ দিন স্কুলের সামনে জমায়েত থেকেও সেই ইঙ্গিতই দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ ততটা আশাবাদী নন। তাঁদের ধারণা, খুব দ্রুত স্কুল খোলার মতো পরিস্থিতি নেই।
বৃহস্পতিবার স্কুলে পৌঁছে দেখা গেল, তাণ্ডবের ৪৮ ঘণ্টা পরেও বিক্ষোভের দগদগে চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্কুল বাড়িটি। সেই ঘটনার জেরে এ দিন যে তিন জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে, সেই দলে রয়েছেন দু’জন অভিভাবকও! অভিভাবকদের মারমুখী চেহারা দেখে রীতিমতো হতাশ রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনও। এ দিন রিজেন্ট এস্টেটে একটি অনুষ্ঠানের শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আমি হতাশ। বাবা-মায়েরাই যদি শৃঙ্খলা না মানেন, তা হলে ছেলেমেয়েদের থেকে আর কীইবা আশা করা যায়!”
মুখে না বললেও এমনই হতাশা ও লজ্জা ঘিরে রেখেছে স্কুলের বেশির ভাগ অভিভাবক, ছাত্রী, এমনকী প্রাক্তনীদেরও। এ দিনের জমায়েতে এক ছাত্রী বলেই ফেলেছে, “স্কুলে ভাঙচুর কোনও শিক্ষিত লোকের কাজ নয়!” আর তাই জমায়েত থেকে স্কুল খোলার দাবির সঙ্গে উঠেছে দোষীদের শাস্তির দাবিও। প্রশ্ন উঠছে, দু’দিন আগেকার তাণ্ডবটা তো মাত্র দু’জন অভিভাবক মিলে করেননি! বাকিদের তা হলে কবে গ্রেফতার করা হবে?
পায়ে পায়ে। প্রতিবাদমুখর ক্রাইস্ট চার্চের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রীরা। শনিবার। ছবি: শৌভিক দে
একই সঙ্গে অভিভাবক ও ছাত্রীদের মনের মধ্যে রয়েছে পড়াশোনার চিন্তা। দশম-একাদশ শ্রেণির ছাত্রীরা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষা নিয়ে চিন্তিত। চতুর্থ-পঞ্চমের মতো নিচু শ্রেণির ছাত্রীদের বাড়ির লোক চিন্তিত বাকি বছরের পড়াশোনা নিয়ে। স্কুল খোলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের একটি অংশ যে অধ্যক্ষা হেলেন সরকারকে ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছেন, তারও বড় কারণ, স্কুলটা যাতে আবার আগের ছন্দ ফিরে পায়। অধ্যক্ষাকে তাঁর পদে রেখে দেওয়ার দাবিও তোলেন কেউ কেউ। এ দিকে, স্কুল যে সংস্থার অধীনে, সেই চার্চ অফ নর্থ ইন্ডিয়া(সিএনআই)-র তরফে জানানো হয়েছে, ঐন্দ্রিলার মৃত্যু এবং স্কুলে ভাঙচুর-সহ অধ্যক্ষার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ খতিয়ে দেখতে দু’টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির রিপোর্ট পেলে তবেই অধ্যক্ষার ইস্তফাপত্র নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই স্কুল গেটের সামনে শুরু হয় জমায়েত। সাড়ে ন’টা থেকেই অভিভাবকেরা তো বটেই, স্কুলের পোশাক পরে হাজির হয় ছাত্রীরাও। সেই দলে দশম-একাদশের ছাত্রীদের পাশে ছিল চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীরাও।
এই জমায়েতেই এক সময় মঞ্চে ওঠেন দক্ষিণ দমদম পুরসভার ১২ নম্বর ওয়ার্ডের নির্দল কাউন্সিলর ফাল্গুনী পুরকায়স্থ। অভিভাবক সমিতির পক্ষ থেকে আমন্ত্রণপত্র পেয়েই সভায় এসেছিলেন, পরে জানান তিনি। কিন্তু বক্তব্য রাখতে উঠলে তাঁকে এক দল অভিভাবক বাধা দেন। হাত থেকে মাইক কেড়ে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। পরে ফাল্গুনীবাবু তৃণমূলের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে বলেন, “এই কাজ করেছে তৃণমূল, অভিভাবকেরা নন।” কিন্তু অভিভাবকদের বক্তব্য, তাঁরা এই জমায়েতকে ঘিরে রাজনীতি চান না। সভায় উপস্থিত এক অভিভাবক বলেন, “এটা রাজনীতির সভা নয়। আমাদের প্রতিবাদ সভা। স্কুল যাতে তাড়াতাড়ি খোলে, তা বলতেই এখানে এসেছি আমরা। উনি মঞ্চে উঠে রাজনীতি নিয়ে কথা বলছিলেন। তাই বাধ্য হয়েছি নামিয়ে দিতে।”
জমায়েত কিন্তু সকালেই শেষ হয়ে যায়নি। প্রাক্তনীরাও যে কতটা চিন্তিত, সেটা বোঝা গিয়েছে সন্ধ্যায়। শ’খানেক প্রাক্তন ছাত্রী হাজির হন স্কুল গেটের সামনে। অধিকাংশই চাকুরিজীবী। স্কুলের ঘটনা নিয়ে নিজেরা যোগাযোগ করে চলে এসেছেন এখানে। তাঁদের অভিযোগ, “একটা ভাল স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এর সিআইডি তদন্ত হোক।” স্কুল খোলার দাবিতে সরব এক পড়ুয়া বলেন, “কাগজপত্র ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। রেজিস্ট্রেশন ফর্ম ছিড়েছে। কয়েক দিন আগে ষাণ্মাসিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। সেই খাতাও ছিঁড়ে ফেলেছে বহিরাগতরা।” দশম শ্রেণির ছাত্রী শ্বেতা সাহার বক্তব্য, “নথি সব নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তাড়াতাড়ি স্কুল খুললে আমরা জানতে পারব, কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নেবেন।” শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য জানিয়েছেন, স্কুলের যে সব নথি নষ্ট হয়েছে, অবিলম্বে তার প্রতিলিপি ছাত্রীদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য তিনি স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন। ছাত্রীদের আশ্বস্ত করে তিনি বলেন, “নথির কারণে কোনও ছাত্রীর পরীক্ষা দিতে অসুবিধা হবে না।”
একই সঙ্গে দাবি উঠেছে অধ্যক্ষাকে ফিরিয়ে আনার। একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রীর বক্তব্য, “আমরা বড়দিকে (অধ্যক্ষা) স্কুলে ফেরত চাই। তাঁকে না আনা হলে আমরা কেউ স্কুলে আসব না।” অভিভাবকদের একাংশের বক্তব্য, অধ্যক্ষা কড়া হাতে স্কুল চালাচ্ছিলেন বলেই অনেকের শত্রু হয়ে ওঠেন। তাই ক্ষুব্ধ অভিভাবকদের একাংশ ও কিছু স্বার্থান্বেষী লোক স্কুলে ঢুকে ভাঙচুর চালিয়ে শিক্ষিকাদের হেনস্থা করেছে। প্রাক্তন ছাত্রী মানালী দত্তের প্রশ্ন, “কোনও শিক্ষিকা স্কুলে নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলতে বললে সেটা অপরাধ হবে কেন? তা হলে তো কোনও শিক্ষিকাই দায়িত্ব নিতে চাইবেন না।” উত্তরা বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক অভিভাবকের দাবি, তাঁর মেয়ে ছোটবেলা থেকেই ক্রাইস্ট চার্চে পড়ছেন, কোনও দিন খারাপ কিছু দেখেননি। তাঁর মন্তব্য, “যত দ্রুত সম্ভব স্কুল খুলেই এর জবাব দিতে হবে।”
অভিভাবকদের বেশির ভাগই অধ্যক্ষাকে ফিরিয়ে আনতে চাইলেও একটি অংশ কিন্তু এ দিনও তাঁর বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। তাঁদের অভিযোগ, অধ্যক্ষা অভিভাবকদের সঙ্গে দেখা করতেন না। এক ছাত্রীর বাবা জানান, অধ্যক্ষার নির্দেশে একটি স্কুলবাস কমিয়ে দেওয়া হয়। ফলে মাত্র দু’টি বাসে ঠাসাঠাসি করে যাতায়াত করতে বাধ্য হয় ছাত্রীরা। তাদের এই সমস্যা নিয়ে বলা হলেও অধ্যক্ষা মাথা ঘামাননি বলে অভিযোগ ওই অভিভাবকের। এক দল অভিভাবক আবার অভিযোগের আঙুল তুলেছেন স্কুলের প্রিফেক্ট (মনিটর) ছাত্রীদের দিকেও। তাঁদের যুক্তি, প্রিফেক্ট ছাত্রীরা শাসন করার নামে শাস্তি দিত, টাকা চাইত, টিফিন খেয়ে নিত। এই অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছে উঁচু শ্রেণির ছাত্রীরা।

পুরনো খবর:
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.