অধ্যক্ষার মুক্তি, হামলাকারীদের শাস্তি চেয়ে পোস্টার
হাজার অনুরোধেও দরজা খুলল না।
“কাকু প্লিজ দরজাটা খুলুন, এক বার স্কুলে ঢুকব। বিশ্বাস করুন, আমরা ভাঙচুর করতে আসিনি, আমাদের ক্লাসরুম, ল্যাবরেটরি দেখতে এসেছি” এক রাশ কচি কণ্ঠের এমন করজোড় মিনতিতেও স্কুলের দরজা খোলেনি। বরং প্রহরারত পুলিশকাকু পাল্টা মিনতি করে জানিয়ে দেন, উপায় নেই। স্কুলে কাউকে ঢুকতে দেওয়ার অনুমতি নেই।
এ বার ফুঁসে উঠল ওই কচিকাঁচারা, “বৃহস্পতিবার এ ভাবে স্কুলের গেট আগলে দাঁড়ালে তো আমাদের প্রিন্সিপ্যাল এবং মিসদের এমন হেনস্থা হতো না! ভাঙচুর হতো না। আমরা দেখতে এসেছিলাম আমাদের ক্লাসরুম, ল্যাবরেটরি অক্ষত আছে কি না। তা-ও দেখতে দিল না।”
স্কুল কবে খুলবে কেউ জানে না। বৃহস্পতিবার দিনভর স্কুলে ভাঙচুর, অধ্যক্ষা গ্রেফতারের ঘটনার পরে শুক্রবার থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধের নোটিস পড়েছে দমদমের ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের গেটে। চার দিক থমথমে। তারই মধ্যে স্কুলের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির বেশ কিছু ছাত্রী ও তাঁদের অভিভাবকেরা হাজির হয়েছেন স্কুল-চত্বরে। তাঁদের সঙ্গে হাজির স্কুলেরই প্রাক্তনীরা। বন্ধ ফটকের গায়ে অধ্যক্ষার শাস্তি চেয়ে পোস্টারটা তখনও জ্বলজ্বল করছে। অধ্যক্ষার গ্রেফতার, শিক্ষিকাদের জুতো দেখানো, স্কুল সম্পত্তি ভাঙচুরের প্রতিবাদে তার পাশেই নতুন পোস্টার সেঁটে দেওয়া হল। এ দিন যাঁরা স্কুল গেটে হাজির ছিলেন, তাঁদের অনেকেরই হাতে ছিল নানা সংবাদপত্র। ভিড়ের মধ্যে বৃহস্পতিবার ভাঙচুরের কুশীলবেরা কেউ রয়েছে কি না, খুঁজে বেড়াচ্ছিল কৌতূহলী চোখগুলি। এক অভিভাবককে বলতে শোনা গেল, “যারা স্কুলের হাল এমন করেছে, অধ্যক্ষাকে জুতো ছুড়েছে তাদেরই খুঁজছি। পেলে আটকে রাখব। পুলিশে ধরিয়ে দেব।”

স্কুলের গেটে শুক্রবার পোস্টার সাঁটছেন ছাত্রীরা।—নিজস্ব চিত্র।
স্কুলের সামনে জড়ো হওয়া অভিভাবকদেরই কয়েক জন চিনিয়ে দিলেন সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় প্রকাশিত একটি ছবির মহিলাকে। তাঁদের দেওয়া ঠিকানা নিয়েই পৌঁছনো গেল নাগেরবাজারের বাপুজি কলোনিতে রেশমী দে-র বাড়িতে। প্রথমে দরজাই খোলেননি রেশমী। বিকেলে দরজা খুলে জানান, তিনি বৃহস্পতিবারের ঘটনার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। তাঁর মেয়ে স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। রেশমীর প্রতিবেশীদের প্রার্থনা, বৃহস্পতিবার তিনি যে ঘটনাটা ঘটিয়ে এসেছেন, তার প্রভাব যেন তাঁর ছোট্ট মেয়েটার উপরে না পড়ে।
এ দিন যাঁরা স্কুলের সামনে জড়ো হয়েছিলেন সেই ছাত্রীদের অভিযোগ ঐন্দ্রিলার মৃত্যুতে শোক জানানোর বদলে অধ্যক্ষা-সহ শিক্ষিকাদের অসম্মান করা হয়েছে, স্কুলের সম্পত্তি ও গুরুত্বপূর্ণ সব নথি নষ্ট করা হয়েছে। দশম শ্রেণির এক ছাত্রী বলে, “সামনেই পরীক্ষা। জীবন বিজ্ঞানের প্র্যাকটিক্যাল খাতা ছিল অধ্যক্ষার অফিস ঘরে। যে ভাবে সেখানে ভাঙচুর হয়েছে তার পরেও কি খাতাগুলো আস্ত আছে?” আর এক ছাত্রীর প্রশ্ন, “আমাদের পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন হয়ে গিয়েছে। টাকাও দিয়েছি। এ বার কী হবে?” গত কালের বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে তাদের প্রশ্ন, “কাল দিনভর টিভিতে যা দেখলাম, সেটা কি শোকের নমুনা? যারা ভাঙচুর করল, তাদের শাস্তি না দিয়ে কেন অধ্যক্ষাকে গ্রেফতার করা হল?” তাদের দাবি, অধ্যক্ষাকে মুক্তি দিয়ে ভাঙচুরের আসামিদের অবিলম্বে গ্রেফতার করুক পুলিশ।
কিন্তু স্কুলের ছাত্রীদেরই কেউ কেউ বৃহস্পতিবার অধ্যক্ষাকে গ্রেফতারের সময়ে হাততালি দিয়েছিল। অধ্যক্ষার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে তাঁর বরখাস্তের দাবি তুলেছিল। এ দিন স্কুলের সামনে যে সব ছাত্রী জড়ো হয়েছিল, তাদের মধ্যে এক দশম শ্রেণির ছাত্রী বলে, “ওদের ছাত্রী বলে ভাবতে লজ্জা হচ্ছে। প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম স্কুলের শৃঙ্খলারক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত কড়া ছিলেন। অনেক ছাত্রী স্কুল চলাকালীন মোবাইল ব্যবহার করে, নখ না কেটে স্কুলে আসার মতো একাধিক শৃঙ্খলাভঙ্গের কাজ করে। তাদের কড়া শাস্তি দেওয়া হয়। সেটা অনেকেরই পছন্দ নয়।”
বৃহস্পতিবারের বিক্ষোভের ঘটনায় রীতিমতো আশঙ্কিত হয়ে পড়েছে স্কুলের একাদশ শ্রেণির ছাত্রীরা। তাদের কথায়, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের অসংখ্য নথি রয়েছে অফিসঘরে। ছিল বিভিন্ন শংসাপত্রও। সব ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে! আশঙ্কিত অভিভাবকেরাও। তাঁদের অভিযোগ, “গত কাল কিছু অভিভাবক ও অসংখ্য বহিরাগত স্কুলে ঢুকে ভাঙচুর করল।” সুদেব দাস নামে এক অভিভাবক বলেন, “আমরা চেয়েছিলাম ঐন্দ্রিলার মৃত্যু নিয়ে অধ্যক্ষা একটি বিবৃতি দিয়ে সকলকে জানান কী ঘটনা ঘটেছিল? কিন্তু আচমকাই এক দল বহিরাগত ও কিছু অভিভাবক উত্তেজনা ছড়িয়ে ভাঙচুর শুরু করল। আটকানোর চেষ্টা করেছিলাম। শিক্ষিকাদের যে ভাবে অসম্মান করা হয়েছে, যেন তাঁরা কোনও অপরাধী। এটা মেনে নিতে পারছি না।” তাঁর অভিযোগ, “আটক শিক্ষিকাদের জল খাওয়ানোর অপরাধে আমাকেও মারধর করা হয়েছে!”
অভিভাবকের অনেকেরই বক্তব্য, এই অধ্যক্ষা স্কুলে যোগ দেওয়ার পরেই শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। ছাত্রীদের কেউ কেউ নানা কুকর্ম করত। ‘হেলেনা ম্যাডামই’ (অধ্যক্ষা) সেই সব কাজ আটকে দেন। তাঁদের অভিযোগ, “এই সব কারণেই ক্ষোভ থেকে ভাঙচুর চালিয়েছেন এক দল অভিভাবক।”
কিন্তু শুক্রবার যারা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, বিস্তর অভিযোগ তাঁদেরও। স্কুলের সামনে না থাকলেও স্কুল থেকে কিছুটা দূরে পাওয়া গেল তাদের কয়েক জনকে। ওই অভিভাবকদের অভিযোগ মূলত ক্লাসের মনিটর বা ‘প্রিফেক্ট দল’-এর ওপর। এক অভিভাবক বলেন, “প্রিফেক্টরা ছাত্রীদের উপরে নানা পীড়ন চালায়। তোলাবাজি করে। অধ্যক্ষা ওই দলটিকে প্রশ্রয় দিতেন। অভিভাবকদের সঙ্গে দেখা করতেন না।”
ওই অভিভাবক বলেন, “বৃহস্পতিবার আমরা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলাম। ভাঙচুর হওয়ার পরে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছি না।”
ছাত্রীদের একাংশের দাবি, স্কুলের অধিকাংশ শৌচাগারের দরজা আটকানো যায় না। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তেও এই তথ্য উঠে এসেছে বলে সূত্রের খবর। পাশাপাশি, ঐন্দ্রিলাকে শৌচাগার থেকে কে উদ্ধার করেছিল, তা নিয়েও দেখা দিয়েছে ধোঁয়াশা। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে স্কুলের নিরাপত্তা রক্ষী থেকে অন্য কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে পুলিশ।

ওঁরা কারা
 
শুভঙ্কর পাল (বাড়িতে পাওয়া যায়নি)
• পরিচয়: বেকার
• ঠিকানা: কাজীপাড়া, নাগেরবাজার
• কেন গিয়েছিলেন: বন্ধুরা গিয়েছিল, তাই
• বাবা বলছেন: অন্যায় করেছে, শাস্তি পাক

রেশমি দে
• পরিচয়: অভিভাবক (মেয়ে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী)
• ঠিকানা: বাপুজি কলোনি, নাগেরবাজার
• কেন গিয়েছিলেন: প্রতিবাদ জানাতে
• এখন বলছেন: ক্ষমা চাইছি

শেখ আজহারউদ্দিন
• পরিচয়: কল সেন্টারের কর্মী
• ঠিকানা: বিমাননগর, কৈখালি
• কেন গিয়েছিলেন: খুড়তুতো বোন পড়ে
• এখন বলছেন: রাগের মাথায় করে ফেলেছি
 
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.