|
|
|
|
আত্মহত্যায় প্ররোচনা থেকে মুক্তি অধ্যক্ষার |
নিজস্ব সংবাদদাতা |
দমদমের ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ঐন্দ্রিলা দাসের মৃত্যুর ময়না-তদন্ত রিপোর্ট এখনও হাতেই পায়নি পুলিশ। তা সত্ত্বেও স্কুলের অধ্যক্ষা হেলেন সরকারের বিরুদ্ধে পুলিশ ছাত্রীটিকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ আনায় শুক্রবার আদালত প্রশ্ন তুলল। যার জেরে শেষমেশ অধ্যক্ষার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ধারাটি প্রত্যাহার করা হল আদালতেই।
বুধবার ঐন্দ্রিলার মৃত্যুর পরে বৃহস্পতিবার অভিভাবক-বিক্ষোভে তার স্কুল সকাল থেকে রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়। উঁচু ক্লাসের মেয়েদের ‘র্যাগিং’-ই মেয়েটির মৃত্যুর কারণ এই অভিযোগ তুলে ঘটনার প্রতিকার ও অধ্যক্ষার প্রকাশ্য ক্ষমাপ্রার্থনার দাবিতে স্কুলে তুমুল ভাঙচুর চলে, শিক্ষিকাদের ঘেরাও করে রাখা হয়। লাঠি চালিয়ে, র্যাফ নামিয়েও পুলিশ পরিস্থিতি সামলাতে পারেনি। রাতে অধ্যক্ষা ইস্তফাপত্র লিখে দেওয়ার পরে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। তার পরে ঘেরাও-অবরোধ ওঠে।
মৃত ছাত্রীর পরিবার স্কুল-কর্তৃপক্ষের নামে থানায় নালিশ করেছিলেন। তার ভিত্তিতে আত্মহত্যায় প্ররোচনাদান ছাড়াও হেলেন সরকারের বিরুদ্ধে অবৈধ ভাবে আটক রাখা, ইচ্ছাকৃত আঘাত, তোলা আদায় প্রভৃতি বিভিন্ন ধারায় মামলা রুজু করেছে। কিন্তু হেলেনকে এ দিন ব্যারাকপুর আদালতের অতিরিক্ত মুখ্য বিচারবিভাগীয় বিচারকের এজলাসে তোলা হলে বিচারক ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায় জানতে চান, মৃত্যুর কারণ স্পষ্ট না-হতেই তাঁর বিরুদ্ধে ছাত্রীকে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ আনা হল কোন যুক্তিতে?
সরকারি আইনজীবী শঙ্করদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এর সদুত্তর দিতে পারেননি। উল্টে তিনি বিচারকের সামনে স্বীকার করে নেন, “যে ঘটনার প্রেক্ষিতে ওই ধারা দেওয়া হয়েছে, তা অপ্রাসঙ্গিক। তাই এফআইআরে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩০৬ (আত্মহত্যায় প্ররোচনা) ধারার উল্লেখ থাকলেও পরে কেস ডায়েরিতে পুলিশ সেটি রাখেনি।” শেষ পর্যন্ত আদালতেই হেলেন সরকারের বিরুদ্ধে ৩০৬ ধারা প্রত্যাহার করে নেয় পুলিশ। তবে সরকারি কৌঁসুলির আবেদনক্রমে জোড়া হয় ৩০৪এ (গাফিলতির কারণে মৃত্যু) ধারা। সব পক্ষের বক্তব্য শুনে আদালত তাঁকে তিন দিনের পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
ময়না-তদন্তের রিপোর্ট আসার আগেই ৩০৬ ধারা প্রয়োগ করায় প্রশ্ন উঠেছে প্রশাসনিক মহলেও। পুলিশ এমন কাজ করল কেন, যা শেষে কোর্টে গিয়ে বদলাতে হল? |
ধারাপাত |
৩৪২: |
অবৈধ ভাবে আটক |
৩২৩: |
ইচ্ছাকৃত আঘাত |
৩৮৪: |
জবরদস্তি টাকা আদায় |
৫০৬: |
ভয় দেখিয়ে বশে আনা |
৩৪: |
সম্মিলিত অপরাধ |
৩০৬: |
আত্মহত্যায় প্ররোচনা(আদালতে প্রত্যাহার) |
৩০৪এ: |
গাফিলতির
জন্য মৃত্যু(আদালতে জুড়েছে) |
|
ব্যারাকপুর কমিশনারেটের গোয়েন্দা-প্রধান (ডিসি-ডিডি) দেবাশিস বেজের ব্যাখ্যা, “অভিযোগের ভিত্তিতে প্রথমে বেশ কিছু ধারা দিয়ে মামলা শুরু করা হয়। পরে তদন্তে অন্য কিছু পাওয়া গেলে ধারা বদলে দেওয়াটা আইনসিদ্ধ। এ দিন তা-ই হয়েছে।” কিন্তু মৃতার পরিবার কি আত্মহত্যার প্ররোচনা নিয়ে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন? ঐন্দ্রিলার বাবা শান্তনু দাস এ দিন জানিয়েছেন, মেয়ের মৃত্যুর পিছনে কারও প্ররোচনা থাকার কথা তিনি অভিযোগপত্রে লেখেননি।
সব মিলিয়ে বিষয়টির গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পুলিশের তরফে মেলেনি বলে প্রশাসনের একাংশের অভিমত। মহাকরণ এ-ও মনে করছে যে, বৃহস্পতিবার ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলে পুলিশের ভূমিকা যথাযথ ছিল না। সরকারের এক শীর্ষ সূত্রের কথায়, “প্রথমত পুলিশ দেরিতে পৌঁছেছিল। পৌঁছেও তারা যা করেছে, সেটা একটু একপেশে। প্রিন্সিপ্যালকে গ্রেফতার করলেও স্কুলে যারা তাণ্ডব চালাল, তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাদের চিহ্নিত করারও চেষ্টা হয়নি।” আজ, শনিবার মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিশ-প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহলের বৈঠক ডেকেছেন। মহাকরণ-সূত্রের ইঙ্গিত, সেখানে প্রসঙ্গটি উঠতে পারে। ঐন্দ্রিলার মৃত্যু সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেছেন, “ঘটনাটি মর্মান্তিক। তার তদন্ত হচ্ছে। কিন্তু ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে ধরনের বিশৃঙ্খলা হয়েছে, তা বরদাস্ত করা যায় না।”
বস্তুত বৃহস্পতিবারের পুলিশি ভূমিকা নিয়ে মহাকরণের ‘অসন্তুষ্টি’র আরও কারণ আছে। প্রশাসনিক-সূত্রের দাবি: পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ওখানে গোড়া থেকেই ব্যর্থ হয়েছে। প্রথমে মহিলা পুলিশ মোতায়েন করা হয়নি। পরে বহু লোক মিলে স্কুলে ঢুকে অবাধে ভাঙচুর চালায়। প্রস্তুতি না-থাকায় পুলিশই কার্যত কোণঠাসা হয়ে পড়ে বলে মহাকরণের অভিযোগ। রাতে অধ্যক্ষাকে গ্রেফতার করে পরিস্থিতি সামাল দেয় পুলিশ। “ঐন্দ্রিলার বাবা প্রিন্সিপ্যালের নামে লিখিত নালিশ করেছিলেন বুধবার। ক্ষোভের আঁচও ছিল। বৃহস্পতিবার সকালেই ওঁকে গ্রেফতার করলে পরিস্থিতি এমন হতো না। পুলিশ অনর্থক দেরি করে ব্যাপারটাকে জটিল করে তুলল।” মন্তব্য মহাকরণের এক কর্তার। পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছে, জলকামান নিয়ে এলেও বৃহস্পতিবার জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কেন তা ব্যবহার করল না?
এর ব্যাখ্যা মেলেনি। তবে ব্যারাকপুর কমিশনারেটের কর্তাদের একাংশের দাবি, তাঁরা যা করেছেন, মহাকরণের নির্দেশ মেনেই করেছেন।
এ দিকে বৃহস্পতিবার সারা দিন ধরে যারা স্কুলে ভাঙচুর চালিয়েছে, তাদের কেউ এখনও ধরা পড়েনি। সংবাদমাধ্যমে ওই সব অভিভাবক ও বহিরাগতদের ছবি বারবার দেখানো হলেও কাউকে পুলিশ চিহ্নিতও করতে পারেনি। পুলিশকর্তাদের দাবি, এ ব্যাপারে ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার রাতে মামলা রুজু হয়েছে। কিন্তু এ দিন সেই এফআইআরে নির্দিষ্ট কারও নাম ঢোকেনি। ডিসি-ডিডি দেবাশিসবাবু শুধু বলেছেন, “তদন্ত চলছে। আমরা খোঁজ-খবর নিচ্ছি।” যে তিন ছাত্রী টাকার জন্য ঐন্দ্রিলাকে শৌচাগারে বন্ধ করে রেখেছিল বলে অভিযোগ, তাদেরও কাউকে চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ। শান্তনুবাবুর অভিযোগ, “মেয়ে বলেছিল, ওই তিন দিদি স্কুলে স্কার্ট পরে আসে।” কেন ওদের চিহ্নিত করা গেল না?
দেবাশিসবাবুর বক্তব্য, “ওদের পরিচয় সম্পর্কে আমরা এখনও নিশ্চিত হইনি। হলেই ব্যবস্থা নেব।” শান্তনুবাবু অবশ্য মনে করছেন, যে সাফাইকর্মী তাঁর মেয়েকে শৌচাগার থেকে উদ্ধার করেছিলেন, তাঁকে জেরা করলে অনেক তথ্য জানা যাবে। তাঁকে কি জেরা করা হয়েছে?
দেবাশিসবাবু বলেন, “তদন্ত চলছে। এখনই কিছু বলতে পারব না।”
এ দিন বিচারপতি এ-ও জানতে চেয়েছিলেন, অধ্যক্ষার বিরুদ্ধে জবরদস্তি টাকা আদায়ের অভিযোগ কেন আনা হয়েছে? জবাবে সরকারি কৌঁসুলি দাবি করেন, “ঐন্দ্রিলার কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায়ের চেষ্টা হয়েছিল। জোর করে তাকে আটকে রাখা হয়েছিল শৌচাগারে। মানসিক নির্যাতন হয়েছিল স্কুলের ভিতরেই। তখন অধ্যক্ষা স্কুলে হাজির ছিলেন। তাই তিনি দায় এড়াতে পারেন না।” হেলেন সরকারের কৌঁসুলি সুভাষ দত্ত পাল্টা সওয়ালে দাবি করেন, তাঁর মক্কেল স্কুলের প্রধান হলেও তাঁর অজান্তে কোনও ঘটনা ঘটে থাকলে তিনি দায়ী থাকতে পারেন না। তাঁকে ঘটনাটি জানানোও হয়নি। বিশদে তদন্ত না-করেই পুলিশ অধ্যক্ষাকে গ্রেফতার করেছে বলে অভিযোগ সুভাষবাবুর।
সওয়াল-জবাব শেষে বিচারক অধ্যক্ষাকে তিন দিনের পুলিশি হেফাজতে পাঠান। হেলেন সরকারকে দেখতে এ দিন সকাল থেকেই ভিড় জমতে শুরু করেছিল আদালত চত্বরে। এমনকী, কিছু লোককে এজলাসের জানলায় ঝুলতে দেখা যায়।
কড়া প্রহরায় বেলা দু’টো নাগাদ অধ্যক্ষাকে পিছনের দিকের দরজা দিয়ে এজলাসে হাজির করায় পুলিশ। মাটি রঙের ছাপা শাড়ি পরে সারাক্ষণ তিনি কাঠগড়ায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
আদালতে হাজির ছিলেন তাঁর দাদা সুশান্ত সেনগুপ্ত। তিনি বলেন, “পুলিশ আমার বোনের বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগ দায়ের করেছে। তা ঠিক নয়। ওর নিজের এগারো বছরের মেয়ে রয়েছে। সন্তানের কষ্ট ও অনুভব করে।” |
পুরনো খবর: ছাত্রীর মৃত্যুতে দমদমে স্কুলের অধ্যক্ষা হাজতে |
|
|
|
|
|