নির্ভয়া-আবেগে স্বাগত মৃত্যুদণ্ড, ভিন্নমত অল্পই
ত ঘৃণ্য অপরাধই হোক, আদর্শগত ভাবে তিনি মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী! ফোনে বলছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তাঁর স্বর চাপা পড়ে গেল, পাশ থেকে স্ত্রী সোনামন মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে। শীর্ষেন্দু-জায়া কথা কেড়ে নিয়ে বলতে থাকলেন, “মৃত্যুদণ্ড তো বটেই! ওদের বাঘের খাঁচায় ফেলে দেওয়া উচিত। মেয়েটাকে যে ভাবে তিলে তিলে ওরা মেরেছে, ঠিক সে-ভাবেই ওদেরও চরম শাস্তি হওয়া উচিত।”
নির্ভয়া-কাণ্ডের দশ মাস বাদে দিল্লির আদালতে সাজা ঘোষণার দিনে কাজ করছে এতটাই তীব্র আবেগ। মৃত্যুদণ্ড কি আদৌ ধর্ষণ কমাতে পারে? সে প্রশ্নটা থেকে যাচ্ছে। মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে শোনা যাচ্ছে কিছু স্বর। আবার নির্ভয়াকে ধর্ষণ ও খুনের নৃশংসতার অভিঘাতে এখন ফাঁসির রায়ের মধ্যেই অনেকে সান্ত্বনা খুঁজছেন।
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত যেমন শীর্ষেন্দু-জায়ার সুরেই কথা বলছেন। “মেয়েটি কী ভাবে ছটফট করতে করতে মারা গিয়েছে, ভাবলে কিন্তু ফাঁসির আদেশেও শান্তি পাচ্ছি না,” বলছিলেন ঋতুপর্ণা। তাঁর কথায়, “নির্ভয়ার ঘটনার পরেও ধর্ষণের মতো অপরাধ ঘটেই চলেছে। আরও কঠিন, নিষ্ঠুর সাজা হলে তবে হয়তো অপরাধীরা এ কাজ করার আগে দু’বার ভাবত।”
এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ ও খুনের মামলায় ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের ফাঁসির আগে তাঁর ক্ষমাভিক্ষার আর্জি নাকচ করে দিয়েছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের তদানীন্তন বিচারপতি শৈলেন্দ্রপ্রসাদ তালুকদার। তিনি নিজে কিন্তু মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষেই কথা বলছেন। শৈলেন্দ্রপ্রসাদবাবুর কথায়, “এ দেশের আইন মেনে তখন ধনঞ্জয়ের আবেদনে আমি সাড়া দিতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু অপরাধ কমাতে মৃত্যুদণ্ড খুব কাজে আসে বলে আমার মনে হয় না।” বস্তুত, বারবার মৃত্যুদণ্ডের দৃষ্টান্ত রাতারাতি ধর্ষণ বা নারী-নির্যাতন কমিয়ে ফেলেছে, এমন নজির কোথাও নেই। আবার ব্রিটেনের মতো দেশ মৃত্যুদণ্ড রদ করার পরে ধর্ষণ হু-হু করে বেড়ে গিয়েছে এমনটাও ঘটেনি। বিচারপতি তালুকদার বরং মনে করেন, “মৃত্যুদণ্ড অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধীকে এক ধরনের শহিদের মর্যাদা দেয়।”
নির্ভয়া-কাণ্ড বা তার পরে এ দেশে পরপর ধর্ষণের ঘটনার পটভূমিতে অবশ্য এই ধরনের বিশ্লেষণ কিছুটা পিছু হটছে। বরং সমাজের বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী, আদালতের এই রায়ই সর্বোত্তম সমাধানসূত্র বলে মনে করছেন অনেকে। “মনস্তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে হিংসার জবাবে হিংসার দাওয়াই স্বাস্থ্যকর না হলেও নির্ভয়ার ঘটনাটি অবশ্যই ব্যতিক্রম,” বলছেন মনস্তত্ত্ববিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল। তিনি মনে করেন, দিল্লির ওই ঘটনায় দুষ্কৃতীরা যে নৃশংসতা ও বিকৃতির পরিচয় দিয়েছে, তাতে কোনও হোমে বা সংশোধনাগারে রেখে তাদের শুধরোনোর চেষ্টা কার্যত অসম্ভব। এমনকী, দিল্লি-কাণ্ডে নাবালক বলে কড়া সাজা থেকে ছাড় পেয়েছে যে আঠারো ছুঁই-ছুঁই তরুণ, তার সংশোধন নিয়েও সংশয়ে নীলাঞ্জনা।
একদা মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী হলেও নাট্যকর্মী-পরিচালক ঊষা গঙ্গোপাধ্যায় এখন মত পাল্টেছেন। “দিল্লির পরে কামদুনি-মুম্বই বা অন্যত্র যা ঘটে গিয়েছে, তাতে ঠিক-ভুলের কচকচি গুলিয়ে যাচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে, কড়া হাতে আইনের শাসন ছাড়া বিকল্প নেই,” বলছেন ঊষা।
সমাজের একটা বড় অংশ, বিশেষত মেয়েদের মধ্যে এই আবেগের প্রতি সংবেদনশীল কবি শঙ্খ ঘোষ। কামদুনির ঘটনার পরে তাঁর আহ্বানেই প্রতিরোধ গড়তে কলকাতার পথে নেমেছিলেন বহু মানুষ। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড ঘোষণায় শঙ্খবাবুও খুব স্বস্তিতে নেই। তাঁর কথায়, “এই ধরনের ঘটনায় যাঁরা মৃত্যুদণ্ড চাইছেন, তাঁদের কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি। শাহবাগ আন্দোলনের সময়েও এমন কষ্ট থেকেই ফাঁসির দাবি উঠেছিল। তবু ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়, ফাঁসির শাস্তিবিধান থেকে আমাদের সরে আসাই ভাল।” ‘মেয়েদের পাড়ায় পাড়ায়’, ‘যমুনাবতী সরস্বতী’র কবি খানিক সংশয়ে, ঠিক কী ধরনের সাজা ধর্ষণের মতো অপরাধ কমতে পারে।
আইনজীবী দ্যুতিমালা বাগচীর মতে, “ছোট থেকে মেয়েদের সম্মান করতে শেখাটা বেশি জরুরি। স্রেফ কারও মা বা স্ত্রী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে। শুধু ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে ধর্ষণের মোকাবিলা সম্ভব নয়।” নীতিগত ভাবে তিনি মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে নন বলে দাবি করেছিলেন নারী আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষ। নির্ভয়াকে খুনের পরে বিচারের প্রক্রিয়া মেনে দোষীদের মৃত্যুদণ্ডকে তিনি স্বাগত জানাচ্ছেন। কিন্তু অধুনা ধর্ষণের সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ডকে অনিবার্য বলে মেনে নেওয়ার যে ধুয়ো উঠেছে, তাতে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন আছে বলে শাশ্বতী মনে করছেন।


মৃত্যুদণ্ড মানে তো কয়েক মুহূর্তে সব শেষ। যাবজ্জীবন বন্দি
রেখে তিল তিল করে এই অপরাধীদের মারলে ভাল হত।
অস্মিতা চক্রবর্তী
সমাজে এমন ধর্ষণও প্রচুর হয়, যেখানে ফাঁসি কেন, কোনও শাস্তিই দেওয়া
হয় না। ফাঁসি নিয়ে বিতর্কের আগে মেয়েদের সম্পর্কে মানসিকতার বদল চাই।
পল্লবী মণ্ডল
ফাঁসির থেকেও কষ্টকর সাজা থাকলে সেটাই দেওয়া উচিত ছিল।
স্কুলস্তর থেকে ছেলেদের চরিত্র গঠন, নৈতিক পাঠ দেওয়া দরকার।
সৌমী গঙ্গোপাধ্যায়
প্রত্যেকেরই মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। নাবালক বলে ছাড় পাওয়াটা মোটেই
সমর্থনযোগ্য নয়। উচ্চতর আদালতেও সাজা যেন কোনও ভাবেই লঘু করা না হয়।
দীপতনু দাস
নাবালক বলে মাত্র তিন বছরের সাজা মানা যায় না। অত
নৃশংসতা করে শুধুমাত্র বয়সের কারণে ছাড় পেল!
সায়ন্তন ঘোষ
এটা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তবে আমাদের দেশে
বিচারপদ্ধতির গতি খুব শ্লথ। এটা ঠিক নয়।
সৌমিলি ঘোষ
ফাঁসি দিয়ে ধর্ষণ নামক ব্যাধি ঠেকানো যাবে না। প্রকৃত শিক্ষা
দরকার। যা মানুষকে বোঝাবে, মেয়েরা ভোগ্যপণ্য নয়।
প্রমা সান্যাল
এরা নিজেদের দোষটা বোঝেনি। এক জন আদালতেই বলেছে,
সে নির্দোষ। বিবেকও যদিও একই ভাবে এদের শাস্তি দিত, আরও ভাল হত।
সোহিনী রায়চৌধুরী
ফাঁসি ওই জঘন্য অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি নয়। কারাগারে
লাগাতার শারীরিক নির্যাতন করা উচিত ছিল।
স্বর্ণালি সেন
আমি ফাঁসিই চেয়েছিলাম। তবে এতে ধর্ষণ নির্মূল হবে বলে মনে
করি না। সেটা করতে হলে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।
শুভ্রজ্যোতি মুখোপাধ্যায়
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.