রতন চক্রবর্তী • কাঠমান্ডু |
আফগানিস্তান ২ (মুস্তাফা, সঞ্জার)
ভারত ০ |
ফুটবলে কোনও নেভিল কার্ডাস থাকলে দশরথ স্টেডিয়ামের বুধবারের স্কোর বোর্ডকে হয়তো গাধাই বলতেন!
সাফ ফুটবলের আর্কাইভে অবশ্য লেখা থাকবে প্রথমবার আফগানদের কাঠমান্ডু থেকে ট্রফি নিয়ে যাওয়ার গৌরব গাথা। কিন্তু উইম কোভারম্যান্স যদি কখনও আত্মজীবনী লেখেন তা হলে সেখানে একটা অংশ অন্তত থাকবেই ‘যত গোল মিস-কান্ড সব কাঠমান্ডুতেই!’
একটা দল কী ভাবে সহজতম সুযোগগুলো নষ্ট করে, ক্রসপিসে বল মেরে-মেরে নিজেরাই বিপক্ষের হাতে ম্যাচ তুলে দিতে পারে, তার উদাহারণ হতেই পারে এ দিনের সুনীল ছেত্রী-রবিন সিংহদের ভারত।
পঞ্চাশ-ষাটের দশকে টিভিতে খেলা দেখার সুযোগ ছিল না। বিদেশ থেকে ম্যাচ খেলে এসে চুনী-পিকেরা বলতেন, দারুণ খেলেও হেরে গিয়েছেন তাঁরা। কাগজগুলোয় হেডিং হত, “ভাল খেলিয়াও ভারত পরাজিত।” তা নিয়ে পরে হাসাহাসি করেছেন অনেকে। এ দিনের ম্যাচ দেখার পর সেটাই ফের মনে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ফুটবলের সার সত্যটা খেলার শেষে বলে দিলেন ভারতের ডাচ কোচ নিজেই। “আমার হাতে কোনও জাদুর টুপি নেই যে পরিয়ে দিয়ে গোল করাব। ফুটবলে গোলটাই সব। সেটাই আফগানিস্তান করেছে। আমরা পারিনি। ভাল খেলা কেউ মনে রাখে না।”
ত্রিভুবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে এসে গতকাল থেকে দাঁড়িয়েছিল আফগানদের দু’টো চার্টার্ড বিমান। তাতে একটা মঞ্চ করে নিয়ে এসেছিলেন ওরা, কাবুল থেকেই। ফুটবলারদের সঙ্গে ট্রফিও নিয়ে যাবেন বলে। সে দেশের ৬০ জন পার্লামেন্ট সদস্য এবং ব্যবসায়ী মিলিয়ে মোট শ’খানেক সমর্থক ছিলেন মাঠে। সেই দলে ছিলেন অন্তত দশ জন মহিলাও। এ দিন রাতেই সেই মঞ্চে সাফ কাপ বসিয়ে নিয়ে দেশে ফিরলেন ওঁরা। শুধুমাত্র অঙ্ক কষে ফুটবল খেলে জিতলেন বিলালরা। গোলকিপার মনসুরের অতিমানব হয়ে ওঠাও ছিল সঙ্গে। তিনিই ম্যাচের সেরা। |
বব হাউটন সাফ কাপ জেতেননি। ব্রিটিশ কোচকে ‘হারানোর’ এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার পর কোভারম্যান্সের মুখও থমথমে। বিলাল-আমেরিদের নিয়ে মাঠে যখন তাদের দেশের শেখ-রা নাচানাচি করছিলেন, গোল হয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইছিলেন তখন ভারতীয় কোচ উদাস দৃষ্টি নিয়ে সে দিকে তাকিয়ে। বুকে ল্যাপটপটা জড়িয়ে নিয়ে বলছিলেন, “এত ভাল খেলেও ম্যাচটা জিততে পারলাম না। অন্তত পাঁচটা গোল করা উচিত ছিল।”
মাঠের মধ্যে তখন কান্নাকাটি শুরু হয়ে গিয়েছে। রবিন সিংহ, আরাতা, মেহতাব, সুব্রত পালরা চোখের কোণে জল নিয়ে ফিরছিলেন রিজার্ভ বেঞ্চে। একমাত্র ব্যতিক্রম সুনীল ছেত্রী। সহকারী কোচ স্যাভিও মেদেইরাকে তিনি বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে কিছু বলছিলেন মনে হল। তাঁকে কেন প্রথম একাদশে রাখা হল না, তা থেকেই সম্ভবত ক্ষোভ। কোভারম্যান্স কিন্তু স্পষ্ট বলে দিলেন, “উইনিং কম্বিনেশন ভাঙতে চাইনি। তাতেও তো প্রচুর গোলের সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল। সুনীলকে যখন নামিয়েছি ও তো হ্যাটট্রিকেরও সুযোগ পেল।” তাতে কিন্তু টিম ইন্ডিয়ায় দোষারোপের পালা থামছে না। মেহতাব যেমন বললেন, “স্ট্রাইকাররা গোল না করলে ম্যাচ জিতব কী করে?”
|
হতাশ ভারতের কোচ। |
ম্যাচের শুরুতেই টিম নিয়ে চমক ছিল। বিদেশি কোচ বলেই সাহস দেখিয়ে অধিনায়ককে বাইরে রেখে টিম নামিয়ে দিয়েছিলেন কোভারম্যান্স। চোট পেয়ে খোঁড়ানো আরাতা ইজুমিকে সুস্থ করে প্রথম একাদশে রেখেছিলেন ডাচ কোচ। তাতে ক্ষতি কিছু হয়নি। বল পজেশন থেকে বল কেড়ে নেওয়া, মাটিতে বল রেখে পাসিং ফুটবলআফগানদের চূড়ান্ত আক্রমণাত্মক মনোভাব এবং শক্তির সঙ্গে সমানে টক্কর দিয়েছে ভারত। গোল ছাড়া সবই করেছেন মেহতাবরা।
কিন্তু শুরুতেই ভারতীয় ডিফেন্ডারদের সামান্য ভুলে প্রথম গোলটা করে গেল আফগানরা। বিলালের পাস ধরে গোল করে যান মুস্তাফা। নবি তখন জায়গায় নেই। গোল হজম করেও ভারতের দাপট ছিল চোখে পড়ার মতো। জেজে এবং ফ্রান্সিসের দু’টো উইং-এ ভর করে আফগান ডিফেন্সকে কোণঠাসা করেও গোল করতে পারেননি কেউই। জেজের একটা শট গোললাইন থেকে ফেরান আফগান অধিনায়ক আমেরি। নব্বই মিনিটের মধ্যে সত্তর মিনিট ছিল শুধুই ভারতের গোল মিসের প্রদর্শনী। সুনীলের দু’টো শট ক্রসপিস এবং বারে লেগে ফেরে। ওয়ান টু ওয়ান অবস্থায় আফগান গোলকিপারকে পেয়েও গোল করতে পারেননি রবিন। সুনীল, ফ্রান্সিসও।
আক্রমণের ঢেউ তুলে টিম ইন্ডিয়া যখন সমতা ফেরানোর জন্য মরিয়া, তখন কোণঠাসা আমেরি, মুজতাবরা পাল্টা আক্রমণে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন বারবার। পেয়েও গেলেন সুযোগ। ২-০ হয়ে গেল। নেপালে প্রায় পঁচিশ হাজারের মতো ভারতীয় থাকেন। তাঁদের একটা বড় অংশ এ দিন মাঠে এসেছিলেন দেশের জয় দেখতে। তারা ১-০ পিছিয়ে পড়ার পরও সমানে চিৎকার করে গিয়েছেন, “জিতেগা ভাই জিতেগা” বলে। কিন্তু দু’গোলের পর তাঁরা মাঠ ছাড়তে শুরু করেন। প্রেসবক্স থেকে রিজার্ভ বেঞ্চের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেই পয়মন্ত নীল জামা পড়ে আসা দীর্ঘদেহী শরীরটা মাথা নিচু করে ঝুঁকে। ছাত্রদের ক্ষমাহীন ভুলের খেসারত তো দিতে হবে তাঁকেই। সারা বিশ্বেই যা দিতে হয় কোচেদের। কোভারম্যান্সের অবশ্য চাকরি যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।
কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রশ্ন উঠবেই, সাফ কাপই যদি ভারত না জেতে তা হলে বিদেশি কোচ রেখে লাভ কী? আজ পর্যন্ত তো কোনও বিদেশি কোচই সাফ দিতে পারলেন না। বব হাউটন, স্টিফেন কনস্ট্যান্টাইন, কোভারম্যান্সকেউ না। ১০ বারের মধ্যে ৬ বারই ট্রফি জিতিয়েছেন স্বদেশি কোচই। কোচ যখন তিনিই, ছেলেরা কেন গোল নষ্ট করছে, তার সমাধান তো কোভারম্যান্সকেই করতে হবে। ‘জাদুর টুপি’ খোঁজার কথা বলে দায় তিনি এড়াতে পারেন না।
ভারত: সুব্রত, নির্মল (ডসন), অর্ণব, গৌরমাঙ্গী, নবি, ফ্রান্সিস, আরাতা, লেনি, মেহতাব, জেজে (সুনীল), রবিন।
|