পিকে-র ফিরে দেখা খুদে শিষ্যদের |
সেই ছোটবেলা থেকেই কাকর চেষ্টা, বকর দৃষ্টি |
সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায় • কলকাতা |
একেবারে নোটবই-কলম বন্ধ করার সময় প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলে উঠলেন, “ধরে নিন, এটা বাংলার সর্বকালের সেরা দুই স্পোর্টসম্যানের উদ্দেশে আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য! যদিও বয়সে আমি ওদের বাবার বয়সি।”
‘ওদের’ মানে লিয়েন্ডার পেজ আর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।
যাঁদের বাবারা ছেলেদের কৈশোরে পাঠিয়ে ছিলেন পিকে-র কাছে ট্রেনিংয়ে। “লিয়েন্ডার তখন বছর দশেক। সৌরভ তার চেয়ে বছরখানেক বেশি। দিল্লি এশিয়াডের আশেপাশে হবে সময়টা,” বললেন যিনি সেই পিকে সামনের মাসে সাতাত্তরে পা দেবেন। একটার পর একটা দরজা খোলার মতো মেলে ধরলেন খুব ছোটবেলার লিয়েন্ডার-সৌরভকে ট্রেনিং দেওয়ার কাহিনি।
|
কী ভাবে যোগাযোগ... |
আগে অনুরোধ করেছিল লিয়েন্ডারের বাবা ভেস পেজ। ওর ছেলেকে একটু দেখে দেওয়ার। তার কিছু দিনের মধ্যে সৌরভের বাবা চণ্ডী এসেছিল একই অনুরোধ নিয়ে। ভেস মনে আছে এক দিন মোহনবাগান মাঠে আমাকে প্র্যাক্টিসের পর ধরে। আর চণ্ডী সিএবি-তে, না অন্য কোথাও এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। আসলে আমার কোচিং সম্পর্কে তখন ময়দানে প্রায় সবার একটা ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে, পিকে-র হাতে পড়া মানে সেই প্লেয়ারের একটা কিছু গতি হয়ে যাবে। আমি একটা কিছু ঠিক করে দেব।
প্রথম দিন দু’জনকে ট্রেনিং করিয়ে ধারণা...
ও ভাবে ওরা একসঙ্গে আমার কাছে ট্রেনিং করত না। সাইতে মোটামুটি সকালের দিকে ওদের নিয়ে পড়তাম। তবে বেশির ভাগ দিনই আলাদা ভাবে। সপ্তাহে দু’-তিন দিন। সেটাও শনি-রবিবারই বেশি হত। মানে যে দিনগুলোয় আমার ক্লাব কোচিং থাকত না। এশিয়াড ক্যাম্প সল্টলেকে শুরু করার পর খানিকটা বাড়তি সময় পেতাম। সব মিলিয়ে বছরখানেক ট্রেনিং করেছে ওরা আমার কাছে। |
|
স্মৃতি সতত সুখের। বুধবার নিজের বাড়িতে পিকে। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস। |
দু’জনেরই যে দুটো ব্যাপার প্রথম দিনই আমাকে মুগ্ধ করেছিল তা হল, দুর্বার আকাঙ্ক্ষা আর প্রতি সেকেন্ডে সজাগ ভাব। অত ছোটবেলায় দু’জনের কারও মধ্যেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা বলতে যা বোঝায় সেটা ছিল না। থাকার কথাও নয়। তবে যেটা খেলছে সেটা খুব ভাল করে খেলার সাংঘাতিক ইচ্ছে ছিল। ওই বয়সেই খুব ভাল শ্রোতা। যা বলতাম, মন দিয়ে শুনত।
|
ট্রেনিংয়ে সাড়া কার বেশি ছিল... |
লিয়েন্ডার আর সৌরভ যতই ছোটবেলা থেকে বন্ধু হোক না কেন, দু’জনের অ্যাটিটিউড কিন্তু আলাদা। সে জন্য কোনও ট্রেনিং হয়তো আমি লিয়েন্ডারকে দেখিয়ে দিলাম, ও তক্ষুনি হুড়মুড় করে সেটা করে ফেলত। সব সময় যেন তৈরি আমার নির্দেশ পালনের জন্য। আবার সৌরভকে যে ট্রেনিংই করাতাম ও প্রথমে একটু ভেবে নিয়ে তার পর সেটা করত। আসলে দেখতাম দু’জনের ট্রেনিং করার পদ্ধতিটা আলাদা। কিন্তু ‘এন্ড রেজাল্ট’ একই বেরিয়ে আসত। দু’জনেই একেবারে পারফেক্ট ট্রেনিং করত। ওই বয়সেও লিয়েন্ডারের তুলনায় সৌরভকে সামান্য স্লথ দেখাত। কিন্তু আসলে সেটা সৌরভের সব জিনিসই সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে ভেবে নিয়ে সঠিক ভাবে করার ক্ষমতা।
দু’জনেই কী দারুণই না ফুটবলটা খেলত! কিন্তু সেখানেও লিয়েন্ডারের স্টাইলটা ছিল প্রখর অনুমানক্ষমতা আর গতি। আর সৌরভ খেলত বেশিটাই বুদ্ধি আর পাওয়ার দিয়ে। মানে সেই সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে ভেবে নিয়ে অপারেট করা। তবে লিয়েন্ডার হুড়মুড়িয়ে কাজটা করলেও সেটা নিখুঁতই হত।
|
কী রকম ট্রেনিং করাতেন... |
সব ট্রেনিংই ছিল মূলত ওদের ক্ষিপ্রতা বাড়ানোর। যত বেশি সম্ভব ওদের রিফ্লেক্স বাড়িয়ে তোলাই আমার উদ্দেশ্য ছিল। এমনিতে ওদের দু’জনেরই স্কিল গড গিফটেড। আমার কাজ ছিল, ওদের আত্মস্থ সেই গুণটাকে টেনে বাইরে বার করে আনা। ট্যালেন্টের সেই কুঁড়িকে প্রস্ফুটিত করা। কোচেদের কাজটাই তাই। অনেকেই বলে, অমুক কোচ তমুক প্লেয়ারকে তৈরি করেছে। সব বোগাস। কেউ কাউকে তৈরি করতে পারে না। আমিও কাউকে কোনও দিন তৈরি করিনি। গৌতম, সুভাষ... কাউকে নয়। যার মধ্যে স্কিল আছে সে সেটা নিয়েই জন্মায়। কোচের কাজ হল প্লেয়ারের আত্মস্থ সেই স্কিলকে ফুটিয়ে তোলা। লিয়েন্ডারদেরও ভেতরের স্কিল আর উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে ফুটিয়ে তোলা ছাড়া আমি কিছু করিনি।
লিয়েন্ডারদের আমি নানা ধরনের স্প্রিন্ট টানাতাম। প্রচণ্ড জোরে দৌড়নোর মাঝে হ্যাঁচকা টানে থামিয়ে দিতাম। জগিং করতে করতে হঠাৎ-ই চূড়ান্ত গতি তুলে দিতাম। আচমকা বডি টার্নিং। নানান স্ট্রেচিং করাতাম।
|
অত ছোটদের জন্যও ভোকাল টনিক... |
দশ-বারো বছরের বাচ্চাকে তো আর ‘দেশ তোমার মা’, ভাবো মায়ের জন্য মাঠে জান দিচ্ছ’ বলার কোনও মানে হয় না। তাই ওই বয়সে লিয়েন্ডার-সৌরভ যে রকমের গল্পটল্প শুনে ইন্টারেস্ট পাবে সেগুলোই বলতাম। বাংলায় ব্রতচারীর জনকই যাকে বলা যায়, সেই গুরুসদয় দত্তের অবিশ্বাস্য লাঠি ঘোরানোর কথা বলতাম। তিনি লাঠিতে গুলিও আটকে দিতেন! এতটাই রিফ্লেক্স! কেরলের একটা খেলা যার নাম কালিয়ারপট্টু তার গল্প শোনাতাম। বিচে খেলাটা বেশি দেখা যায়। হাতে একটা গামছা নিয়ে বিপক্ষের তরোয়াল আটকে দেওয়া। অবিশ্বাস্য গতিতে গামছাটা ঘোরানোর কায়দা জানা চাই। মানে সেই রিফ্লেক্স!
|
খুদে শিষ্যদেরও কঠিন মানসিকতা... |
ওদের বাবাদের বলতাম, তোমাদের ছেলেদের তো ‘কাকর চেষ্টা, বকর দৃষ্টি! মানে যত কঠিন কাজই হোক না কেন সেটা করেই ছাড়বে। ওই বয়সেই সেটা বোঝা যেত। ফুটবলারদের জন্য শিয়ালদহের টেনিয়ার দোকানের সিঙাড়া-জিলিপি কোনও দিন প্র্যাক্টিসে নিয়ে গেলে কান্নাকাটি পড়ে যেত! মানে, আজ প্রদীপদা আগে খাইয়েদাইয়ে তার পর খাটিয়ে মেরে ফেলবে! লিয়েন্ডার-সৌরভের বাচ্চা বয়সেও ওদের জন্য কিন্তু আমাকে এক দিনও চকলেট নিয়ে যেতে হয়নি। ভুলিয়ে-ভালিয়ে বেশি খাটানোর জন্য। |
|
পঞ্চাশ, পঁচাত্তর, একশো মিটারের স্প্রিন্ট |
প্রচণ্ড গতিতে দৌড়ের মাঝেই হঠাৎ
পুরো থেমে পড়া |
জগিং করতে করতে আচমকা চূড়ান্ত
গতিতে দৌড় |
গতিশীল অবস্থায়
বডি টার্নিং |
নানা ধরনের স্ট্রেচিং |
বাংলার ব্রতচারীদের
রিফ্লেক্স ক্ষমতার নানা কাহিনি শোনানো |
খুদে শিষ্যদের
মধ্যেও উচ্চাকাঙ্ক্ষা
জাগিয়ে তোলা |
|
|