বাইরে কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলতেন ‘ক্ষমাদেব ভট্টাচার্য’! দলের ভিতরেও প্রশ্ন বিস্তর। কেন এত ভুল স্বীকার? কেন এত আত্মসমালোচনা? এতে নিজেদের দুর্বলতাই প্রকট হয়!
তাঁর আত্মসমালোচনার পথ নিয়ে যাবতীয় প্রশ্ন এ বার উড়িয়ে দিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাঁর যুক্তি, আত্মসমালোচনায় বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে। স্বচ্ছতা থাকে। ভুল স্বীকার করলে তবেই ভুল শোধরানোর দিকে এগোনো যায়। এতে অন্যায় নেই। অসম্মানেরও কিছু নেই। এবং এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর হাতিয়ার চিন।
গত বছরের সম্মেলন-পর্বের মতো এ বার সিপিএমের রাজ্য কমিটি এবং বর্ধিত রাজ্য কমিটির বৈঠকেও বেশ কিছু প্রশ্ন উঠেছিল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর আত্মসমালোচনার ‘লাইন’ নিয়ে। নানা মঞ্চে নিজেদের এত সমালোচনায় আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলার আশঙ্কাও উঠে এসেছিল বৈঠকে। কিন্তু বুদ্ধবাবুর পাল্টা প্রশ্ন, চিনের কমিউনিস্ট পার্টি যদি তাদের পলিটব্যুরো সদস্যদের পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডের সামনে দাঁড় করাতে পারে, সিপিএমের অসুবিধা কোথায়?
আত্মসমালোচনা নিয়ে সিপিএমে বিতর্ক খুব নতুন নয়। সেই সুর বজায় রেখেই রাজ্য কমিটিতে উত্তর ২৪ পরগনার এক প্রাক্তন সাংসদের প্রশ্ন ছিল, এত আত্মসমালোচনা কেন? তা প্রকাশ্যেই বা কেন? প্রকাশ্যে আত্মসমালোচনা করলে কৌশলে করা উচিত। কলকাতার এক প্রাক্তন মন্ত্রীর বক্তব্য ছিল, কঠোর আত্মসমালোচনা আখেরে আত্মবিশ্বাসে ভাঙন ধরায়।
সমালোচকেরা কেউই বুদ্ধবাবুর নাম করেননি। কিন্তু খোদ বুদ্ধবাবু বুঝেছেন, নিশানা তিনিই! তাঁর জবাব, আত্মসমালোচনায় ভয় কেন, দ্বিধাই বা কেন? এতে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে। মানুষের আস্থা পাওয়া যায়। চিনের কমিউনিস্ট পার্টি তো প্রকাশ্যেই কঠোর আত্মসমালোচনা করে! পলিটব্যুরো সদস্যরাও বিচারের হাত থেকে নিষ্কৃতি পান না (এখনই যেমন সে দেশে বিচার চলছে পলিটব্যুরো থেকে বহিষ্কৃত বো শিলাইয়ের)। প্রয়োজনে মৃত্যুদণ্ডও হয়। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তি, সরকার চালাতে গিয়ে বা দল পরিচালনা করতে গিয়ে যে সব ভুলভ্রান্তি জনজীবনে প্রভাব ফেলেছে, প্রকাশ্যেই তা স্বীকার করা ভাল। আবার যে ভুল দলের অন্দরের কাজকর্মের সঙ্গে জড়িত, তা নিয়ে আত্মসমালোচনা হবে সংগঠনের অন্দরেই। বুদ্ধবাবু নিজেই যে কাজ হাতে-কলমে করে থাকেন। সিপিএমের রাজ্য কমিটির এক সদস্যের কথায়, “ভুল মেনে আত্মসমালোচনা করেন বলেই বুদ্ধবাবু এখনও আমাদের দলের জনপ্রিয়তম নেতা। রাজ্য রাজনীতিতে ভুল নিয়ে চর্চা তো এখন উঠেই গিয়েছে! এখনকার শাসক দল কি কোনও ব্যাপারে তাদের ভুল মানতে প্রস্তুত? সিঙ্গুরের ভুল তারা কোনও দিন মানবে?”
সিপিএমের রাজনীতিতে প্রকাশ্যে আত্মসমালোচনার তত্ত্বের প্রবলতম প্রবক্তা বুদ্ধবাবুই। তাঁর পূর্বসূরি জ্যোতি বসু সেই প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রশ্নে এক বার সাক্ষাৎকারে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ সংক্রান্ত মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু বুদ্ধবাবুই এই ক্ষেত্রে ধারাবাহিক। তাঁকে অনুসরণ করে এখন আত্মসমালোচনা করতে দেখা যায় সূর্যকান্ত মিশ্র, গৌতম দেবদেরও। বুদ্ধবাবু অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই ভুল স্বীকার এবং আত্মসমালোচনা বজায় রেখেছেন। গত বছর কলকাতা জেলা সম্মেলনের রাজনৈতিক প্রতিবেদনে লেখা হয়, আত্মসমালোচনা দলের ক্ষতি করছে। তার পরে রাজ্য সম্মেলনেও প্রশ্ন উঠেছিল। সেখানে জবাব না-দিলেও প্রকাশ্যে ধর্মঘট-বিরোধিতা ভুল হয়েছিল বলে দুঃখপ্রকাশ করেন বুদ্ধবাবু। আর এ বার সরাসরি নিজের মতের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন।
চিনের কমিউনিস্ট পার্টির মতো নেতাদের পদে থাকার সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার যে প্রস্তাব রাজ্য কমিটিতে এক প্রাক্তন সাংসদ তুলেছিলেন, সেই প্রশ্নে নীরবই থেকেছেন বুদ্ধবাবু। রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুও সে কথা তোলেননি। দলের অন্দরের সমালোচনা টাকাপয়সার বিনিময়ে কিছু নেতা বাইরে প্রকাশ করছেন বলে অভিযোগ করে রাজ্য সম্পাদককে চিঠি দিয়ে খতিয়ে দেখার আর্জি জানিয়েছেন রাজ্য কমিটির এক সদস্যা! দলের বাকি নেতারা এমন অভিযোগে যারপরনাই বিস্মিত! |