রাজ্যপাল চান রাজনীতিমুক্ত ছাত্র সংসদ।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তি ও পঠনপাঠনের পরিবেশ বজায় রাখতে ছাত্র সংসদের নির্বাচন থেকে রাজনীতিকে দূরে রাখার পক্ষে সওয়াল করছেন শিক্ষাবিদেরাও।
কিন্তু রাজ্য সরকার যে সে-পথে হাঁটবে না, সোমবার তা স্পষ্ট করে দিলেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। এ দিন একটি কলেজের অনুষ্ঠানের পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি জানান, রাজনীতিমুক্ত ছাত্রভোট নয়। সরকার চায়, হিংসামুক্ত ছাত্রভোট।
কিন্তু বাংলার ঐতিহ্য বলছে, দলীয় রাজনীতির অবাধ উপস্থিতিতে ছাত্রভোট হবে এবং তা হিংসামুক্তও হবে, এ আসলে সোনার পাথরবাটি! বাইরে থেকে দলীয় রাজনীতি ঢুকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে দাপট দেখায় প্রতি মুহূর্তে। ছাত্র ভর্তি আর ছাত্র সংসদের নির্বাচন, মূলত এই দু’টিকেই পাখির চোখ করে তারা।
ক্ষমতায় এসে মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়ের সরকার শিক্ষা ক্ষেত্রকে দলীয় রাজনীতিমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু এ দিন তাঁর সরকারের শিক্ষামন্ত্রী স্পষ্টই জানিয়ে দিলেন, ছাত্র সংসদের নির্বাচন থেকে দলীয় রাজনীতিকে দূরে রাখার কোনও অভিপ্রায় তাঁদের নেই। অথচ ছাত্র সংসদের নির্বাচনে দলীয় রাজনীতির তাণ্ডবে ফেব্রুয়ারিতেই গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজের সামনে প্রাণ গিয়েছে এক পুলিশকর্মীর। তারও আগে প্রাণ গিয়েছে আন্দুল কলেজের এক ছাত্রের। আশুতোষ কলেজে এক ছাত্রের চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
কয়েক দশক ধরেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রভোট এবং হিংসা-রক্তপাত প্রায় সমার্থক হয়ে গিয়েছে। অনেক শিক্ষাবিদ মনে করেন, রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের কর্মী তৈরির কারখানা হিসেবেই দেখে। ক্ষমতায় এসে মমতার আশ্বাসে অনেকেই আশান্বিত হয়েছিলেন। কিন্তু এ দিন শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণায় তাঁরা হতাশ।
৩ সেপ্টেম্বর ন্যাশনাল হাইস্কুলের একটি অনুষ্ঠানের শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে রাজ্যপাল বলেছিলেন, “আমি চাই রাজনীতিমুক্ত ছাত্র সংসদ ও ছাত্র সংসদ নির্বাচন।” তাঁর এই মন্তব্যের বিরোধিতায় সরব হয় এসএফআই, তৃণমূল ছাত্র পরিষদ, ছাত্র পরিষদের মতো ছাত্র সংগঠন।
রাজ্যপাল যা চান, সেই প্রসঙ্গ ওঠায় ব্রাত্যবাবু এ দিন বলেন, “আমার প্রশ্ন, সাধারণ নির্বাচনে কি কোনও সন্ত্রাস হয় না? ১৯৫২ সালের পরে যত নির্বাচন হয়েছে, সবেতেই সন্ত্রাস হয়েছে। তা বলে রাজনৈতিক দলগুলি কি প্রতীক ছাড়াই লড়বে?” শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য, রাজনীতিমুক্ত ছাত্র সংসদ শুনতে ভাল। এই নিয়ে আলোচনা, চর্চা হতে পারে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এটা একটা সরলীকৃত মনোভাব বলেই মনে করেন তিনি। ব্রাত্যবাবুর কথায়, “সরকার এই সরলীকৃত সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর জন্য ব্যস্ত হতে পারে না।”
হিংসা মোকাবিলার কী হবে?
শিক্ষামন্ত্রী জানান, ছাত্র সংসদের নির্বাচনে যাতে হিংসা ঠেকানো যায়, তার জন্য বিশেষ নিয়ম তৈরি করা হবে। তবে সেই নিয়ম কী হবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। বিষয়টি নিয়ে বিভাগের পদস্থ আমলাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে বলে জানান মন্ত্রী।
এমন কিছু কারণ থাকে, যার জন্য বহু নিয়মকানুন তৈরি করেও সাধারণ নির্বাচনে হিংসা এড়ানো যায় না। দলীয় রাজনীতির অবাধ অনুপ্রবেশের মধ্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের ভোট হলে সেই সব কারণও বহাল থাকবে। তা হলে হানাহানি বন্ধ করা সম্ভব কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গঠিত লিংডো কমিশন ছাত্র সংসদের নির্বাচনে গণ্ডগোল ঠেকাতে বেশ কিছু সুপারিশ করেছিল। কমিশনের অন্যতম সুপারিশ ছিল, ছাত্র সংসদের নির্বাচনে রাজনৈতিক সংস্রব এড়িয়ে চলতে হবে। কিন্তু সেই সুপারিশ রূপায়ণে আদৌ কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি।
রাজনৈতিক দলগুলি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ভবিষ্যতের কর্মী তৈরি করে। ছাত্র-রাজনীতির হাত ধরেই উত্থান খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতার। বাম দলগুলিরও অনেক নেতা পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছেন ছাত্র-রাজনীতির হাত ধরে। তাই রাজনৈতিক দলগুলি ছাত্র সংসদ থেকে রাজনীতিকে একেবারে বাদ দিতে উদ্যোগী হয়নি কখনওই। তা সে বাম আমলই হোক বা এখনকার তৃণমূল জমানা। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের অভিন্ন বিধি তৈরি হলেও তা থেকে রাজনীতিকে পুরোপুরি বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়নি কখনওই।
অথচ শিক্ষা নেওয়ার মতো দৃষ্টান্ত রয়েছে হাতের কাছেই। সেন্ট জেভিয়ার্স, রামকৃষ্ণ মিশনের কলেজ, গোখেল মেমোরিয়াল, লেডি ব্রেবোর্ন। মেধাবী পড়ুয়ারা এই সব প্রতিষ্ঠানই পছন্দ করেন। এ-সব জায়গায় রাজনীতিযুক্ত ছাত্র সংসদ নেই বলে কি ছাত্রছাত্রীরা রাজনীতি-সচেতন হয়ে উঠতে পারেন না প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষানুরাগীদের মধ্যে। কিছু কাল আগেও ছাত্র-সংঘর্ষ, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে জর্জরিত ছিল বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি বা বেসু-র ক্যাম্পাস। ছাত্র সংসদের নির্বাচন এড়িয়ে ওই প্রতিষ্ঠান এখন শান্ত।
এই সব প্রতিষ্ঠানের কথা তোলায় ব্রাত্যবাবু অন্য দৃষ্টান্ত দেন। তাঁর দাবি, “অনেক রাজনৈতিক ছাত্র সংসদও তো আছে, যেখানে অশান্তি নেই। যেমন, চন্দননগর, হুগলি মহসিন, সরোজিনী নায়ডু কলেজে।” রাজ্যে কলেজের সংখ্যা ৪৫০-র বেশি। এই ক’টি দৃষ্টান্তই ছাত্রভোটে রাজনীতি বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট কি না, তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন থেকেই যায়! |