রাজ্য সরকার আর পাহাড়ের আমজনতা জোড়া চাপের মুখে পড়ে বনধ নিয়ে আরও খানিকটা পিছু হটতে বাধ্য হলো গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। আপাতত দু’দিনের জন্য বনধ শিথিল করে আজ তারা জানিয়ে দিল, আগামী ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর (সোম ও মঙ্গলবার) পাহাড়ে সরকারি অফিস ছাড়া সবই খোলা থাকবে।
গত কাল মোর্চার নেতৃত্বাধীন জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এ মাসের ১৩ তারিখ থেকে স্কুল-কলেজকে বনধে ছাড় দেওয়া হবে। কিন্তু বাকি সব কিছু বন্ধ থাকলে ছাত্রছাত্রীরা কী ভাবে স্কুল-কলেজে যাবেন, সেই প্রশ্ন ওঠে। একই সঙ্গে প্রশ্ন ওঠে, জনজীবন যদি স্বাভাবিক না হয়, তা হলে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ছাড় দিয়ে লাভ কী? সেই প্রশ্নের মুখেই পিছু হটতে হল বিমল গুরুঙ্গদের।
মোর্চার প্রবল বিরোধিতার মুখে কালিম্পং সফর করে ইতিমধ্যেই মোর্চার উপরে চাপ বাড়িয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বনধ উপেক্ষা করে যে ভাবে মানুষের ঢল নেমেছিল তাঁর সভায়, তাতে উজ্জীবিত রাজ্য প্রশাসন। কিন্তু রাজ্য যখন মোর্চার আন্দোলন সম্পর্কে কড়া মনোভাব নিচ্ছে, তখন কেন্দ্রীয় সরকারের নেতারা মোর্চা নেতাদের সঙ্গে দেখা করায় মুখ্যমন্ত্রী ক্ষুব্ধ। তাঁর অভিযোগ কেন্দ্র ভাঙনের রাজনীতি করছে। এ নিয়ে গত কাল প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিও লিখেছেন মমতা।
মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ নিয়ে আজ সংসদে সরব হলো তৃণমূল। গত ৩ তারিখ রোশন গিরি-সহ মোর্চা নেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে কেন বৈঠক করলেন, সেই প্রশ্ন তোলেন দলীয় সাংসদেরা। তাঁদের প্রতিবাদের জেরে সংসদের দু’কক্ষই কিছু ক্ষণের জন্য অচল হয়ে যায়। শেষে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আর পি এন সিংহ বিবৃতি দিয়ে বলেন, রাজ্যকে না জানিয়ে পাহাড়ের ব্যাপারে কিছু করা হবে না।
মোর্চার উপরে চাপ বাড়াতে এ দিন ফের পাহাড়ের জনজীবন পুরোপুরি স্বাভাবিক করার কথা বলেন রাজ্যের দুই মন্ত্রী। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব মোর্চা নেতাদের উদ্দেশে বলেন, “পাহাড়ের মানুষ বনধ উপেক্ষা করে বাইরে বার হতে শুরু করেছেন। আমার অনুরোধ, তাঁদের আর দুর্দশায় ফেলবেন না।” আর পর্যটনমন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরীর বক্তব্য, “কাশ্মীরেও বনধ হলে পর্যটনকে ছাড় দেওয়া হয়। আমি গুরুঙ্গদের কাছে অনুরোধ করব, পাহাড়ের জনজীবন স্বাভাবিক রেখে সেখানকার অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ পর্যটন শিল্পকে আরও ক্ষতির হাত থেকে বাঁচান।” |
এর পরই শুক্রবার সন্ধ্যায় গোর্খাল্যান্ড জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটির চেয়ারম্যান এনোস দাস প্রধান বলেন, “১৩ সেপ্টেম্বর থেকে স্কুল-কলেজ বনধের আওতার বাইরে থাকবে। বাইরের পড়ুয়াদের পাহাড়ে পৌঁছতে হবে। প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনতে হবে। সে কথা মাথায় রেখে ৯ এবং ১০ সেপ্টেম্বর সরকারি অফিস ছাড়া সব কিছুকেই বনধের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে।” তা হলে বনধ কবে থেকে পুরোপুরি তোলা হবে? তাঁর জবাব, “দিল্লিতে মোর্চার যে প্রতিনিধিরা গিয়েছেন, তাঁরা সকলে এখনও ফেরেননি। ১০ তারিখ দুপুরের মধ্যে ফিরবেন। সে দিন ফের বৈঠকে বসে পরের কর্মসূচি ঠিক হবে।”
মুখরক্ষার উপায় খুঁজতে মোর্চা যখন দিল্লির মুখাপেক্ষী, তখন তাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা আজ দিল্লিতেই পৌঁছে দিলেন মমতা। তাঁর নির্দেশে সংসদের অধিবেশন শুরুর আগে সংসদ চত্বরে গাঁধী মূর্তির পাদদেশে প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন-সহ বিক্ষোভ দেখান তৃণমূলের সাংসদরা। তাতে লেখা, দার্জিলিং নিয়ে কেন্দ্র যেন রাজনীতি না করে। এর পর সংসদের দুই কক্ষেই সরব হন তাঁরা। যার জেরে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বিবৃতি: “মুখ্যমন্ত্রীকে না জানিয়ে কিছু করা হবে না। আমরা রাজ্যকে সঙ্গে নিয়েই ত্রিপাক্ষিক বৈঠক করব।” তিনি আরও জানান, এক জন সাংসদ (যশোবন্ত সিংহ) প্রতিনিধি দল নিয়ে এসেছিলেন বলেই অসুস্থ অবস্থাতেও দেখা করেছিলেন শিন্দে। তিনি ওই বৈঠকে মোর্চা নেতাদের ধর্মঘট এবং বিক্ষোভ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিতেই বলেছিলেন। বৈঠকের সময় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগেরও চেষ্টা করা হয়। কিন্তু মমতা তখন কালিম্পঙে জনসভায় ব্যস্ত। পরে বিকেল সাড়ে তিনটের সময় শিন্দে নিজেই মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করে বৈঠক সম্পর্কে জানান।
চলতি অধিবেশনে প্রায় সব বিল নিয়েই কংগ্রেস তথা মনমোহন সরকারের তীব্র বিরোধিতা করেছে তৃণমূল। এবং কার্যত এই নিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু সেগুলি ছিল সর্বভারতীয় বিষয়। আর দার্জিলিং হল রাজ্যের নিজস্ব বিষয়। এই বিষয়টি কংগ্রেস-বিরোধিতার সঙ্গে জুড়ে মমতা আগেই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে রাজ্যের বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলেছিলেন। মনে করা হচ্ছে, এ দিন সংসদে হইচইয়ের পরে সেই আন্দোলন আরও গতি পেল।
কেন বিষয়টি মমতা এ ভাবে খড়গহস্ত হলেন কেন্দ্রের উপর?
রাজনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গ থেকে দার্জিলিঙের আলাদা রাজ্য হওয়ার এই আন্দোলনের মোকাবিলা করতে মমতা সম্প্রতি একটি কুশলী চাল দিয়েছেন। এর আগেই তিনি পাহাড়ের লেপচা জনজাতির জন্য একটি স্বতন্ত্র উন্নয়ন পর্ষদ গঠন করেছিলেন। সাম্প্রতিক সফরে ওই পর্ষদের গুরুত্ব বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। বরাদ্দ বাড়ানো, ভবনের জন্য জমি দেওয়া, কর্মসংস্থান, লেপচা সংস্কৃতির পুর্নবিকাশের জন্য একাধিক পদক্ষেপ করে এক কথায় লেপচাদের মন জিতে নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। ফলে পার্বত্য জনগোষ্ঠীর আন্দোলন বিভাজিত হয়ে কার্যত দুর্বল হয়ে গিয়েছে। |
এমতাবস্থায় গুরুঙ্গদের সঙ্গে কেন্দ্রের বৈঠককে মমতা সরাসরি তুলে ধরছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রয়াসকে নষ্ট করে দেওয়ার চক্রান্ত হিসেবেই। লোকসভায় সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “পশ্চিমবঙ্গকে ভাগ করার জন্য জোর করে চেষ্টা করা হচ্ছে। এর পিছনে কেন্দ্রের ভূমিকা রয়েছে।” মমতা যে চিঠিটি প্রধানমন্ত্রীকে লিখেছিলেন, সেটি সংসদে পড়ে শোনান সুদীপবাবু। গত ১ অগস্ট প্রধানমন্ত্রী যে চিঠিটি লিখে মমতাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন (রাজ্য সরকারকে অন্ধকারে রেখে জিটিএ-র কাজকর্মে নাক গলানোর উদ্দেশ্য কেন্দ্রের নেই), পড়া হয় সেটিও। রাজ্যসভায় ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেন, “কেন্দ্রের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, মুখ্যমন্ত্রী অনেক চেষ্টার পর পাহাড় পরিস্থিতি আয়ত্তে এনেছেন। দয়া করে এই প্রয়াস নষ্ট করে দেবেন না।” অন্য দিকে, কংগ্রেস সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করছেন তিনি একাই দার্জিলিঙের সমস্যার সমাধান করবেন। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ডাকতেই হবে।”
সংসদে তৃণমূলের বিক্ষোভ নিয়ে এ দিন গোর্খাল্যান্ড জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটির বৈঠকেও আলোচনা হয়। কমিটির চেয়ারম্যান বলেন, “তৃণমূল নিজেদের দলীয় ঐতিহ্য মেনেই বিক্ষোভ দেখিয়েছে। এতে আমাদের কিছু বলার নেই। গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে আন্দোলন আরও কী ভাবে জোরদার করা যায়, আমরা সেটা নিয়ে ভাবছি।” পাহাড়ে ধরপাকড় এ দিনও অব্যাহত। দার্জিলিং পুরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মীরা শর্মা-সহ তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁদের মুক্তির দাবিতে সন্ধ্যা থেকে জোড়বাংলো থানা ঘেরাও করে মোর্চা। শুক্রবার পাহাড়ে সব মিলিয়ে মোর্চার ৫৮ জন কর্মী-সমর্থককে গ্রেফতার করা হয়েছে। |